প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

‘ফ্ল্যাট-জমি’ কিনে মাদক কর্মকর্তার কালো টাকা সাদা

নজরুল ইসলামঃ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তার স্ত্রীর নামে ১ কোটি ৫ লাখ ৮১ হাজার ৫৬০ টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ পাওয়া গেছে। নিজেকে ব্যবসায়ী এবং ব্যবসার টাকায় এসব সম্পদ কিনেছেন বলে তার দাবি। কিন্তু, আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ এর ১৯বিবিবিবিবি ধারা অনুযায়ী তিনি আয়কর পরিশোধ করেছেন। এ ধারাটি কালো টাকা সাদা করার ধারা। সে হিসাবে এসব সম্পদ ‘কালো’ টাকায় কেনা হয়েছে বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।

এ কর্মকর্তার নাম ফজলুর রহমান। তিনি রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক। তার আগে তিনি ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক ও চট্টগ্রামের উপপরিচালক ছিলেন। তার স্ত্রী মাফরুহা আঞ্জুম চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুদক আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারায় মামলা দায়েরের অনুমোদন দিয়েছে দুদক কমিশন। তাদের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলায়।

সম্পদ বিবরণীতে ফজলুর রহমানের স্ত্রী মাফরুহা আঞ্জুম চৌধুরী নিজেকে একজন ‘রাখিমালের’ ব্যবসায়ী হিসাবে দেখিয়েছেন। তার নামে ট্রেড লাইসেন্সও আছে। কিন্তু, সরেজমিন পরিদর্শন করে তার কোনো গোডাউন পাওয়া যায়নি। তার দাবি, ২০১৩ সালের পর থেকে তিনি আর বড় পরিসরে ব্যবসা করেননি। প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন গৃহিণী বলেই প্রতীয়মান হয়েছে দুদকের কাছে।

সম্পদ বিবরণীতে দাখিল করা তথ্য অনুসারে তার নামে ঢাকার কলাবাগানে ১৫৫৬ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। যার দলিল মূল্য দেখিয়েছেন ৬৮ লাখ ৭৬ হাজার ৫৬০ টাকা। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ৫ কাঠা জমির দলিল মূল্য ৩১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। বগুড়ার মালতিনগরে .০৬৫১ অযুতাংশ জমি ও ৪৮০ বর্গফুটের ৫টি দোকান ঘরের দলিল মূল্য ৫ লাখ ৮০ হাজার টাকাসহ মোট ১ কোটি ৫ লাখ ৮১ হাজার ৫৬০ টাকার সম্পদ রয়েছে।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, মাফরুহা আঞ্জুম চৌধুরী তার আয়কে ব্যবসা থেকে হয়েছে দাবি করেছেন। সেটাই যদি হয়, তাহলে কেন তিনি আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ এর ১৯বিবিবিবিবি ধারা অনুযায়ী আয়কর পরিশোধ করলেন? এছাড়া তার দেখানো ১ কোটি ৫ লাখ ৮১ হাজার ৫৬০ টাকার সম্পদের বাজার মূল্য আরো বেশি বলে প্রতীয়মান।

অভিযোগের বিষয়ে ফজলুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘অবৈধ কোনো কিছু নেই। অভিযোগ আগেই নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।’ তবে আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ এর ১৯বিবিবিবিবি ধারা অনুযায়ী তার স্ত্রীর নামে থাকা সম্পদের আয়কর পরিশোধের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

দুদকের আইন শাখা জানিয়েছে, মাফরুহা আঞ্জুম চৌধুরীর ১ কোটি ৫ লাখ ৮১ হাজার ৫৬০ টাকার সম্পদ বাবদ ১৯বিবিবিবিবি ধারায় আয়কর প্রদান এবং ব্যবসায়িক আয়ের সঠিক উৎস পাওয়া যায়নি। আয়কর অধ্যাদেশের ১৯বিবিবিবিবি ধারায় কোনো ব্যক্তি সম্পদ প্রদর্শন করতে হলে সে ব্যক্তিকে জুলাই ২০০৯ থেকে জুন ২০১০ এরমধ্যে বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু, তিনি প্রদর্শিত ফ্ল্যাট ক্রয়ে বিনিয়োগ করেছেন ২০০৮ সালের ২৬ এপ্রিল থেকে ২০০৯ সালের ২৮ জুলাই তারিখে। পরে ২০১২-২০১৩ করবর্ষে তিনি ওই ফ্ল্যাট বাবদ ৩৯ লাখ ২২ হাজার ৫৬০ টাকা পরিশোধ দেখিয়েছেন। আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবসার কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে তিনি গৃহিণী এবং আয়ের উৎস ছিল না। একইভাবে বসুন্ধরায় কেনা ৫ কাঠা জমি ২০১২-২০১৩ করবর্ষে দেখালেও জমি ক্রয়ে আয়ের উৎস হিসেবে রাখিমালের ব্যবসা দেখানো হয়েছে, যার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ এর ১৯বিবিবিবিবি ধারায় প্রদর্শিত আয়ের বৈধ কোনো উৎস নেই। সেই হিসেবে ১ কোটি ৫ লাখ ৮১ হাজার ৫৬০ টাকা তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ। ওই ধারায় আয়ের উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না মর্মে আয়কর দাতাকে কোনো দায়মুক্তিও দেয়া হয়নি।

উল্লেখ্য, ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় কোনো কিছু উল্লেখ না করেই আয়কর আইনে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ চিরদিনের জন্য স্থায়ীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ জন্য আয়কর অধ্যাদেশে ১৯ (ই) নামে নতুন একটি ধারা সংযোজন করা হয়। এ ধারা অনুযায়ী, অতীতের যেকোনো বছরের আয় গোপন করা হয়ে থাকলে ১০ শতাংশ হারে জরিমানা দিয়েই তা বৈধ করা যাবে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আরেকটি স্থায়ী পদ্ধতি আয়কর অধ্যাদেশে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর সেটি হচ্ছে ১৯বিবিবিবিবি। এর মাধ্যমে ফ্ল্যাট ও জমি কিনে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়।

উল্লেখ্য, ফজলুর রহমান ২০০০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ২০১২ সালে চট্টগ্রাম গোয়েন্দা আঞ্চলিক কার্যালয়ে উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তখন দুদকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ে। ২০১৩ সালে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ জারি করে দুদক। সে অভিযোগ পরিসমাপ্তও হয়েছিল। কিন্তু, অনুসন্ধান করে তার স্ত্রীর অবৈধ সম্পদ পেলো দুদক। তার স্ত্রী ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সময়ে স্কুলে শিক্ষকতা ও টিউশনি করে সঞ্চয় করেন। পরে তিনি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় মজুত মালের ব্যবসা শুরু করেন বলে সম্পদ বিবরণীতে দাবি করেন।