প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

বর্তমান বৈশ্বিক জাতীয়তাবাদ ব্যবসার জন্য ক্ষতিকর

International business concept with businessman on New York city background with network on map and sunlight

লিসে কিংগো ও স্কট ম্যাথার: বহুত্ববাদ ও বৈশ্বিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে নানা ধরনের হুমকি ক্রমেই বাড়ছে। এতে ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ব্যবসায়ী ও আর্থিক খাতের নেতাদের এ বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সুতরাং এটি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তাদের আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছাই থেকে বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তবে ওই সম্পর্ক আজকের দিনে এসে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। বহুত্ববাদ ও যেসব সংস্থা একই ধরনের লক্ষ্য পূরণে কাজ করছে, তারা এখন এ ধরনের প্রশ্নের মধ্যে পড়ে গেছে। এর মধ্যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও), জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মতো সংস্থাগুলোও রয়েছে। তাদের প্রশ্নের মুখে পড়ার কারণ হলোÑঅনেক দেশ এখন উগ্র জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তাদের কারণে কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হচ্ছে, এমনকি তা একপর্যায়ে সংঘর্ষে গড়াচ্ছে। এর পরও ব্যবসা-বাণিজ্য ও আর্থিক খাতের নেতারা এই সমস্যা সৃষ্টিকারী পরিস্থিতিতেও এর বিরুদ্ধে আরও বেশি উদ্যোগী হচ্ছেন না কেন?
যুদ্ধপরবর্তী ইতিহাসে দেখা যায়, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণ বিশেষ করে আরও বেশি মুক্ত বাণিজ্য এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে ব্যাপক বিনিয়োগ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে। এতে বিশ্বের অনেক অংশে বাজারব্যবস্থা ও সমাজে উন্নতি হয়েছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জীবনযাত্রার মানে উন্নতি হয়েছে। এটাও সত্য যে, এ কারণে হওয়া বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বের অনেক অংশে ব্যাপক সামাজিক ভারসাম্যহীনতাও তৈরি হয়েছে। জনগণের মধ্যে অসন্তোষ তৈরির ক্ষেত্রে এটি বাড়তি জ্বালানি হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। তবে এটি এড়িয়ে চলার ফলে যে ব্যবস্থাগুলো সম্পদ তৈরি করে, দারিদ্র্য দূর করে ও বিশ্বব্যাপী মধ্যবিত্ত শ্রেণির জায়গা আরও বৃদ্ধি করে সেগুলো হুমকিতে পড়ছে। এ পন্থা অনুসরণকারীর সংখ্যাও ক্রমেই বাড়ছে।
ব্যবসা ও বিনিয়োগ খাত তর্কসাপেক্ষে মুক্ত, নিয়ম-নীতিযুক্ত আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক আদেশের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পায়। তার পরও সিইও এবং চেয়ারম্যানরা খুব কমই বহুপক্ষীয় এবং বৈশ্বিক সহযোগিতা রক্ষায় তাদের প্রভাব রাখার মতো বক্তব্য ব্যবহার করেছেন।
এটা করা হয় একেবারেই আংশিকভাবে, কারণ অধিকাংশ বেসরকারি উদ্যোগ এখনও জাতীয় আইন এবং নীতির সঙ্গে লবিং করার ব্যাপারে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এমনকি এক্ষেত্রে বাণিজ্য অ্যাসোসিয়েশনকেও মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
বৈশ্বিক ব্যধি ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আর্থিক খাতের নেতাদের চুপ থাকার কোনো সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী ও নতুন বৈশ্বিক সহযোগিতা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তারা তিনটি ধাপে কাজ করতে পারেন।
শুরুতেই ডব্লিউটিও ও জাতিসংঘের মতো মূল সংস্থাগুলোর আবশ্যকতা ও নীতিগুলো আবার উদ্ঘাটন এবং তা প্রতিপালনে তাদের দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া জরুরি। এই সংস্থাগুলো বিশ্বাস করে যেসব দেশ একত্রিত হয়ে কাজ করে, তারা একা চলা দেশগুলোর তুলনায় দীর্ঘমেয়াদে বেশি লাভবান হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি একটি উদ্যোগ নেন। এ উদ্যোগের মাধ্যমে একটি বহুত্ববাদী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে এতে তার মতো ব্যক্তিত্বরা আঞ্চলিক সংস্থা ও উদ্যোগের সঙ্গে একত্র হয়ে কাজ করতে পারেন।
দ্বিতীয়ত, ব্যবসায়ের প্রধানরা বহুজাতিক বেসরকারি উদ্যোগগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন জানাতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জাতিসংঘের বৈশ্বিক অখণ্ডতার এবং দায়িত্বশীল বিনিয়োগের নীতিতে স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা এখনও অত্যন্ত কম। আরও অনেককেই এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে এবং এতে স্বাক্ষর করতে হবে।
এটার মাধ্যমে এবং এ ধরনের অন্য উদ্যোগগুলো দুভাবে সহযোগিতা করতে পারে। এর মধ্যে অনেকেই ব্যাপকহারে সহযোগিতামূলক সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত। জাতিসংঘের বৈশ্বিক কম্প্যাক্টগুলোও এর আওতায় রয়েছে। অন্য কথায় বলতে গেলে, তারা নিজিদের বৈশ্বিক সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন খাত, সুশীল সমাজসহ অন্যান্য জায়গাগুলোতে নিজেদের যুক্ত করছে। সেখানে তারা বৈশ্বিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আলোচনা করছে। এর মধ্যে আইনের শাসন, বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো নানা বিষয় রয়েছে।
এছাড়া বৈশ্বিক নীতিনির্ধারকরা সহযোগিতার নতুন সম্ভাবনা তৈরির মাধ্যমে এই উদ্যোগ ও জোটগুলোয় ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করছে। উদাহরণস্বরূপ জাতিসংঘের কথা বলা যায়। সম্প্রতি সংস্থাটি বহুত্ববাদের মধ্যে আর্থিক ব্যাপারগুলো মিশিয়ে দেওয়ার একটি নীতি গ্রহণ করা শুরু করেছে। এজন্য একটি বার্ষিক বিনিয়োগ ফোরামের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সরকার ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সহযোগিতা ও চুক্তি করাকে উৎসাহিত করা হবে।
সর্বশেষ বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও আর্থিক খাতের নেতারা নতুন বৈশ্বিক টেকসই নীতিগুলো ত্রিমাত্রিক করতে পারে। এটাই তর্কসাপেক্ষে বর্তমান হুমকি, চ্যালেঞ্জ ও নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভালো প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করতে পারে। এছাড়া এটা একটি বৈশ্বিক ইতিবাচক প্রভাব তৈরির ক্ষেত্রে দারুণ সুযোগ সামনে নিয়ে এসেছে।
সুষম উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৭টি লক্ষ্য এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো মানবতারই প্রতিচিত্র। এছাড়া আমরা এতে আরও যোগ করতে পারি এ লক্ষ্যমাত্রা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্যও করা হয়েছে। এসডিজি অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বায়ন আরও বেশি সুষম এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলতে পারে, যে সময়টাতে জলবায়ু পরিবর্তনকেও একটি হুমকি হিসেবে ব্যাপকভাবে বলা হচ্ছে।
নিজস্ব ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিকল্পনায় এসডিজি’কে যুক্ত করে নেওয়া উচিত বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর। ব্যবসা ও সুষম উন্নয়নবিষয়ক কমিশন এর আগে হিসাব করে জানায় কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীরা ২০৩০ সালের মধ্যে ১২ লাখ কোটি ডলারের বাজার উম্মুক্ত করতে পারে। এছাড়া এসডিজি’র মাত্র প্রধান কয়েকটি লক্ষ্যমাত্রা অনুসরণ করেই অন্তত ৩৮ কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হতে পারে।
গত জানুয়ারিতে দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংস্থার (ডব্লিউইএফ) বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে জাতিসংঘের বৈশ্বিক ব্যবস্থা এবং পিমকো যৌথভাবে বিশ্বের কোম্পানি, বিনিয়োগকারী ও সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় যে, তারা যেন এসডিজি বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করে। এছাড়া অর্থায়নের মাধ্যমে সেগুলো আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করার আহ্বান জানায় তারা। বিশেষ করে এসডিজির বন্ধনের মতো নতুন কোনো পন্থা সামনে আনার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করার আহ্বানও জানানো হয়।
বৈশ্বিক সহযোগিতা আমাদের সবার নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সফলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটা এখন অত্যন্ত ঝুঁকিতে রয়েছে। বহুত্ববাদে প্রকাশ্যেই সমর্থন দেওয়ার মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নেতারা আরও সমৃদ্ধ ও সুষম ভবিষ্যৎ তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। এটা তাদের সংস্থার জন্য ও সমগ্র বিশ্বের জন্যও।

লিসে কিংগো, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, জাতিসংঘ গ্লোবাল কমপ্যাক্ট ও
স্কট ম্যাথার, যুক্তরাষ্ট্রের মুখ্য কৌশলগত প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা, পিমকো
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে ভাষান্তর: তৌহিদুর রহমান