প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ইসলামিকের প্রথম বর্ষপূর্তি: যেতে হবে বহুদূর

মুন্সী মো. আশফাকুল আলম: ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা একটা সময় মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোয় সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকেও প্রভাবিত করেছে। লন্ডন এখন ইসলামিক ফাইন্যান্সের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। যেখানে ৬টি ইসলামিক ব্যাংকসহ কমপক্ষে ২০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামিক আর্থিক সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। ১৯৯৭ সালে ওসিসির মাধ্যমে ইসলামিক রিটেইল হোম ফাইন্যান্সের অনুমোদনের মধ্য দিয়ে আমেরিকায় ইসলামিক ফাইন্যান্সের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে জার্মানিতে ইউরোজোনের সর্বপ্রথম ইসলামি ব্যাংক হিসেবে কে.টি ব্যাংক এ.জি কাজ শুরু করে। বর্তমানে জার্মানিতে ২টি পূর্ণ ইসলামিক ব্যাংক রয়েছে। ২০২২ সালে রাশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামিক ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; যা ইসলামিক আর্থিক ব্যবস্থার সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ বহন করে। অধিকতর সুস্থির বাজার পরিস্থিতি এবং উন্নত নিয়ন্ত্রণমূলক প্রেক্ষাপটের ধারণা থেকে মুসলিম সংখ্যালঘিষ্ঠ দেশগুলো কর্তৃক ইসলামি বিনিয়োগ প্রদান ২০১৭ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়Ñইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা শরিয়াহ বা ইসলামি আইন মেনে চলে। শুধু তাই নয়, এটা ঝুঁকি ও মুনাফা ভাগাভাগির নীতিভিত্তিক ব্যবস্থা। শরিয়াহভিত্তিক অর্থায়নে পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে মুনাফা অর্জিত হয় যেখানে সুদভিত্তিক লেনদেন নিষিদ্ধ এবং অ্যালকোহল, পর্নোগ্রাফি ও জুয়া-সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে এ ধারার অর্থায়ন নিষিদ্ধ! এমন সব কল্যাণমূলক কাজের বিনিময় হিসেবে বিশ্বজুড়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে ইসলামি অর্থ ব্যবস্থা। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুযায়ী, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো কর্তৃক মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাইরে ইস্যুকৃত সার্বভৌম সুকুক বা ইসলামিক বন্ডের মূল্য বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে; যা ক্রমান্বয় হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ খাতে প্রবেশ করা প্রথম মুসলিম সংখ্যালঘিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছেÑসিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, লুক্সেমবার্গ এবং হংকংয়ের নাম। পৃথিবীব্যাপী শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি পণ্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑমুদারাবা (মুনাফা ভাগাভাগি) মুশারাকা (মুনাফা ও ক্ষতি সম্মতহারে ভাগাভাগি), মুরাবাহা (নির্দিষ্ট মুনাফায় বিনিয়োগ), ইজারা (নির্ধারিত ভাড়ার ভিত্তিতে লিজ প্রদান), সুকুক (ইসলামিক বন্ড)। বিশ্বাস এবং আস্থার কারণেই চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও ইসলামি অর্থনীতি খাতের উন্নয়ন হচ্ছে। বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানিগুলো বিকল্প তহবিল সূত্র ও বৃহত্তরসংখ্যক বিনিয়োগকারী অন্বেষণ করার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালে আরও সম্প্রসারিত হয়ে এ শিল্পের আকার ৩.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। আইসিডি রিফিনিটিভ ইসলামিক ফিন্যান্স ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট-২০২১ অনুযায়ী গ্লোবাল ইসলামিক ফিন্যান্স অ্যাসেট এবং ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যাসেট ২০২৫ সাল নাগাদ যথাক্রমে ৪৯৪০ বিলিয়ন ডলার এবং ৩৩০৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।

বাংলাদেশে এর অবস্থা কেমন? এই ব্যাখ্যার আগে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যায় ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর আর্থিক পোর্টফলিও, যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। দেশের বেশিরভাগ প্রচলিত ধারার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ক্রমেই উদ্যোক্তারা তাদের প্রতিষ্ঠানকে ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থাতে পরিবর্তন করছেন অথবা উইন্ডোভিত্তিক ইসলামিক ব্যাংকিং সেবা দেয়ার ব্যবস্থা করছেন। আইএফএসআই স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যাসেট গ্লোবাল ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যাসেটের ২.৭ ভাগ। অদূর ভবিষ্যতে এ দেশের ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার কলেবর আশাতীত অতিক্রম করবে বলে ধারণা ইসলামী বোদ্ধাদের।

এত সম্ভাবনার ইসলামি অর্থনীতি নিয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স যা করছে তার ব্যাখ্যায় প্রথমেই বলে নেয়া দরকার, দেশে প্রচলিত ধারার নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স লিমিটেড সর্বপ্রথম ইসলামিক ফাইন্যান্সিং কার্যক্রম শুরু করে ২০২২ সালে। ৪ জানুয়ারি, ২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের চূড়া??? অনুমোদন পেয়ে পরদিন ৫ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের ৬টি শাখায় একযোগে ইসলামিক উইং কার্যক্রম শুরু করে। যাত্রা শুরুর এক বছরে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ইসলামিকের অর্জন অনেক; পাশাপাশি যেতে হবে বহুদূর!

বিগত ১ বছরে দেশসেরা স্কলারদের সমন্বয়ে গঠিত আমাদের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কমিটির অনুমোদনক্রমে ইসলামিক ডিপোজিট ও ইনভেস্টমেন্টের উদ্ভাবনী সব প্রডাক্ট ডিজাইন করা হয়েছে এবং তদানুযায়ী ডিপোজিট সংগ্রহ ও ইনভেস্টমেন্ট প্রদানের কার্যক্রম চলছে। ইতোমধ্যে আমরা শরিয়াহ ম্যানুয়াল, শরিয়াহ অডিট ম্যানুয়ালসহ বেশ কিছু প্রডাক্ট প্রোগ্রাম গাইডলাইন প্রণয়ন করেছি; যার মাধ্যমে সব ধরনের রিটেইল ও করপোরেট গ্রাহকসেবা প্রদানে আমাদের শতভাগ প্রস্তুতি রয়েছে।

ডিপোজিট সংগ্রহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ইসলামিক, মুদারাবা নীতির অনুসরণে নানা প্রডাক্ট ডিজাইন করেছে; যার মধ্যে মুদারাবাহ টিডিআর, মুদারাবাহ প্রফিট আর্নারস স্কিম, মুদারাবাহ ক্যাশ ওয়াক্ফ স্কিম, মুদারাবাহ মাসিক ডিপিএস, মুদারাবাহ হজ স্কিম, মুদারাবাহ ওমরাহ স্কিম, মুদারাবাহ রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান অন্যতম। ইতোমধ্যে আমাদের ইসলামিক পোর্টফলিও দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ কোটি টাকায়। এত অল্প সময়ে এই পোর্টফলিও বলে দেয়, কতটা আস্থা এবং বিশ্বাসের পরিচায়ক ইসলামিক ফাইন্যান্সিং। সব প্যারামিটারে দেশের ব্যাংকিং পোর্টফলিওর প্রায় ২৮ শতাংশ এখন ইসলামিক ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্সের দখলে। প্রতিনিয়ত কল্যাণমুখী এ ব্যাংকিং ধারার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ইসলামিক এই ধারার গর্বিত অংশীদার হতে পেরে আনন্দিত।

শরিয়াহসম্মত বিনিয়োগ পদ্ধতির মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আমরা কৃষি, নারী উদ্যোক্তা, ব্যবসায়িক কার্যক্রম, ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল, নির্মাণকাজ, অটো ফাইন্যান্স, হোম ফাইন্যান্স, পার্সোনাল ফাইন্যান্স খাতে (রিটেইল ও করপোরেট সেক্টরে) বিনিয়োগ করে আসছি। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাই মুরাবাহা, বাই মুয়াজ্জাল এবং হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করছি। ইসলামের আলোকে নিত্যনতুন সব উদ্ভাবনী আগামীর সম্ভাবনাকে দৃঢ় করছে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার কৃষি খাত, নারী উদ্যোক্তা এবং নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য রিফাইন্যান্স স্কিমের মাধ্যমে স্বল্প মুনাফায় বিনিয়োগের ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ইসলামিক সেই রিফাইন্যান্স স্কিমের মাধ্যমে স্বল্প মুনাফায় প্রান্তিক পর্যায়ে বিনিয়োগ প্রদান করার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে; যা টেকসই ইসলামি অর্থব্যবস্থাকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

ফিনটেক ও ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রি একই সূত্রে গাথা। ফিনটেক ছাড়া ব্যাংকিং অপারেশন্স অকল্পনীয় হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। তাই বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ফিনটেকভিত্তিক ইনোভেটিভ সেবা প্রদানের লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। অ্যাপভিত্তিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকেই বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের সেবা গ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে।

আমরা তৃণমূল পর্যায়ে আর্থিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি; এরই অংশ হিসেবে রিটেইল ডিপোজিট গ্রাহক অন্তর্ভুক্তি ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগ গ্রহীতাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা প্রদান করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ইসলামিক। গ্রাহকের প্রচলিত আস্থা ও নির্ভরতা এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা; সেবার এই মানদণ্ডকে দ্রুত অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

হেড অব ইসলামিক ফাইন্যান্সিং ডিভিশন

বাংলাদেশ ফাইন্যান্স লিমিটেড

[email protected]