রোববার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মাসব্যাপী ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আপনারা শুধু কয়েকটি দেশ ঘুরে কোন দেশ জিএসপি দিলো না, সেজন্য স্যারদের পেছনে না ঘুরে নিজেরাই অন্য বাজার খুঁজে বের করেন। তখন ওরাই আপনাদের পেছনে দৌড়াবে।’ তার এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা কঠিন। একই সঙ্গে উদীয়মান চামড়াশিল্প খাতের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে নতুন বছরের জন্য চামড়া, পাদুকাসহ চামড়াজাত পণ্যকে জাতীয়ভাবে প্রডাক্ট অব দি ইয়ার ঘোষণাকেও স্বাগত জানাতে হয়। পাশাপাশি আমরা প্রত্যাশা করি, প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যকে বার্তা হিসেবে নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাত উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হবে।
এখানে বিদ্যমান বাস্তবতাও ভুলে থাকা চলে না। লক্ষণীয়, ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে দুই ধরনের বাজার সৃষ্টির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে: এক. অভ্যন্তরীণ ও দুই. আন্তর্জাতিক। অভ্যন্তরীণ বাজার সৃষ্টির ওপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছেন তিনি। একদিক থেকে কাজটি সহজ বটে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দ্রুত ও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তাতে করে সার্বিকভাবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে নিঃসন্দেহে। ফলে এখানে বাজার সম্প্রসারণের সম্ভাবনা স্পষ্টভাবে বিরাজমান। ওই দ্রুত ও উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি নতুন চ্যালেঞ্জেরও ইঙ্গিতবহ। কেননা ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচিতেও পরিবর্তন এসেছে অনিবার্যভাবে। ফলে আগে যেভাবে নিম্নমানের পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে বাজার সম্প্রসারণ করা যেতো, তা আর সম্ভব হবে না এখন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মার্কেট স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ জটিল বৈকি। আমরা চাইবো, বিষয়টি মাথায় নিয়ে এগোবেন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। এক্ষেত্রে জনপ্রশাসনের উচিত মাঠপর্যায়ে সম্ভাব্য উদ্যোক্তাদের উপযুক্ত সুবিধা জোগানো, যাতে এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারণ সহজ হয়।
আন্তর্জাতিক বাজারের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নীতিনির্ধারকদের বেশি করে অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপরই জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন অনেকে। কেননা বিশ্ববাজারের গুণগত পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে এরই মধ্যে। লক্ষণীয়, বিশ্বায়ন বিশেষত বিশ্বায়িত বাণিজ্য ব্যবস্থা থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশ। আর সেক্ষেত্রে তাদের সমৃদ্ধির প্রধান উৎস স্বভাবতই ছিল শিল্পায়িত অগ্রসর অর্থনীতিগুলো। অথচ মূল ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত উন্নত বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই এখন বিশ্বায়নবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি প্রবল। গত বছর ব্রিটেনে ব্রেক্সিট গণভোটের পর বিশ্বায়নবিরোধী শক্তির উত্থান সূচিত হয়। তারপরও অনেকের আশাবাদ জিইয়ে ছিল। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি দেয় গত বছর নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়। শুরু থেকেই বিশ্বায়িত বাণিজ্যের বিরোধিতা করে আসছেন তিনি। সেগুলো কতটা ও কীভাবে প্রয়োগ করা হবে, তা এখনও দেখার বিষয় অবশ্য। কিন্তু সত্যিই যদি তিনি বিশ্বায়নের উল্টো পথে চলা শুরু করেন, প্রধানমন্ত্রী যেমনটি বলেছেন, জিএসপির প্রত্যাশী হয়ে বসে থাকাটা আমাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। সেজন্য এখন থেকেই নতুন বাজার অন্বেষণ শুরু করা দরকার। আর সেক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির ওপরই অধিক জোর দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি একই স্বার্থে মজবুত সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, রাশিয়ার মতো অর্থনৈতিক পরাশক্তির সঙ্গে। সেক্ষেত্রে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি সরকারের দায়িত্বও কম নয়। আমরা আশা করবো, ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের শুধু উপদেশ নয় বাজার সম্প্রসারণে তাদের দিকনির্দেশনাও জোগাবেন নীতিনির্ধারকরা।