নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে নানা ধরনের সংকট বিরাজ করছে। এসবের মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে অস্থিতিশীলতা, তারল্য সংকট, ব্যাংক খাতে অনিয়ম, বাণিজ্য ঘাটতি, বিদ্যুৎ খাতে অযৌক্তিক ক্যাপাসিটি চার্জ, বিভিন্ন খাতে অযাচিত ভর্তুকি ইত্যাদি। তবে বর্তমানে অর্থনীতিতে যেকোনো সমস্যার জন্য কভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা হয়। কিন্তু এসব সময় কেবল এ দুই কারণেই ঘনীভূত হয়নি। বরং এগুলো দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা এবং তা ধীরে ধীরে ঘনীভূত হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে ব্যাপকভিত্তিতে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।
আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে নানা ধরনের সংস্কারমূলক কর্মসূচি নেয়ার এমন তাগিদ দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। রাজধানীর ধানমন্ডিতে সংগঠনটির নিজস্ব কার্যালয়ে গতকাল ‘জাতীয় বাজেট ২০২৩-২৪: সিপিডির সুপারিশমালা’ শীর্ষক এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব বিষয় তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। উপস্থিত ছিলেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খানসহ অন্যান্য গবেষকরা।
সংগঠনটি অর্থনীতির ছয়টি বিষয়ে নিজেদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে। এগুলো হলোÑ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, বাজেটীয় কাঠামো, পণ্যমূল্য, সরকারি ভর্তুকি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা এবং পরিবেশগত উদ্বেগ। এবার বাজেট সুপারিশের মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয় ‘ঝড় মোকাবিলা ও ঝুঁকি সামাল দেয়া’।
গত কয়েক বছর ধরেই বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকায় স্থির রাখা হয়েছে। এটিকে কমপক্ষে সাড়ে তিন লাখ টাকা করার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি। এর পেছনে যুক্তি হিসেবে সংস্থাটি বলছে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও হ্রাস পেয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো না হলে কম আয়ের মানুষের ওপরই করের বোঝা বেশি বাড়বে। এছাড়া ২০২০ সালে উচ্চপর্যায়ের করদাতাদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। এমন সিদ্ধান্তের কারণে ধনিক শ্রেণি আরও বেশি সুবিধা পাচ্ছে। তাই ব্যক্তিশ্রেণির আয়করের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সিলিং পুনরায় ৩০ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি।
জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য তামাকপণ্যের কর নির্ধারণে বড় ধরনের সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি। বর্তমানে দেশে অ্যাড ভেলোরাম পদ্ধতিতে তামাকপণ্যের কর আহরণ করা হয়। এতে সরকার রাজস্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আনুপাতিক হারে তামাক কোম্পানির মুনাফাও বাড়ে। ফলে বাড়তি মুনাফা দিয়ে তামাক কোম্পানির আরও বেশি ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ পায়। এমন পরিস্থিতিতে তামাক কোম্পানির মুনাফা যাতে খুব বেশি না বাড়ে তা নিশ্চিত করতে অ্যাড ভেলোরাম পদ্ধতির পরিবর্তে নির্দিষ্ট পদ্ধতি বা স্পিসিফিক ট্যাক্স স্ট্রাকচার চালু করার প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি। এক্ষেত্রে যেকোনো স্তরের সিগারেটই হোক না কেন প্রতিটি সিগারেট শলাকা থেকে নির্দিষ্ট হারে ১০ টাকা করে রাজস্ব আহরণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তামাক কোম্পানির করপোরেট কর হার বর্তমানের ৪৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘আগামী বাজেট হবে দেশের অর্থনৈতিক সংস্কার ও ঝুঁকি কমানোর বাজেট। এ জায়গা থেকে সব থেকে আগে নজর দিতে হবে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার দিকে। পাশাপাশি রাজস্ব আহরণ, নিত্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখা, মূল্যস্ফীতির লাগাম ধরে রাখার দিকে নজর দিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎ খাতে অবিবেচনাপ্রসূত ক্যাপাসিটি চার্জের কারণে বিদ্যুৎ খাতে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। আর সরকার ভর্তুকি সমন্বয় করতে গিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে দফায় দফায়। এভাবে ক্যাপাসিটি চার্জের দায় ভোক্তাদের ওপর চাপানো যাবে না। ভর্তুকি কমাতে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ পদ্ধতিতে সংস্কার আনতে হবে। বর্তমানে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎেকেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ সরবরাহ না করেও ক্যাপাসিটি চার্জ নিতে পারে। এ ব্যবস্থা সংস্কার করে ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পে’ ব্যবস্থা চালু করতে হবে।’ এ সময় তিনি বাজেট শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানান।
তিনি বলেন, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের চিত্র মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। বর্তমান এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে অর্থবছর শেষে রাজস্ব ঘাটতি ৭৫ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। রাজস্ব আহরণ গত সাত মাসে তিন দশমিক এক শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক সূচকে আনা ও আগামী ছয় মাসে কীভাবে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে সেটা বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতি বছর এনবিআরকে বড় ধরনের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া এবং সেটা কখনই পূরণ করতে পারে না।’
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘২০২৩ সালের রাজস্ব আহরণের ঘাটতি নিয়ে আইএমএফ যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, আমাদের মনেও সেই আশঙ্কা রয়েছে। এনবিআরের সম্পদ আহরণে দুর্বলতা রয়েছে। রাজস্ব আহরণের আওতা দিন দিন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে সরকারের ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদের সর্বশেষ বাজেট হতে যাচ্ছে এটি। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সরকার কতটুকু তা মোকাবিলা করতে পারবে সেটা দেখার বিষয়।’ তিনি আরও বলেন, সরকার করের আওতা না বাড়িয়ে যারা কর দেয় তাদের ওপর নতুন করে করের বোঝা চাপিয়ে দেয়।’
সুশাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়াই অর্থনীতির বড় দুর্বলতা উল্লেখ করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, আমাদের অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে এখন আর বড় ধরনের সংকট বলা যাচ্ছে না। অর্থনীতির ভেতরের দুর্বলতা বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ কিছুটা কারণ হয়ে থাকলেও বড় প্রতিবন্ধকতা নয়। অভ্যন্তরীণ নীতিমালার দুর্বলতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা না পাওয়াই অর্থনীতির বড় দুর্বলতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাইরের অভিঘাত বিবেচ্য বিষয় হলেও মূল নিয়ামক নয়। সেটা বিবেচনা নিয়ে সরকারকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। নির্বাচনের আগের বছরে সেটা নেয়া কতটা সহজ হবে সেটা সময় বলে দেবে। তিনি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে অনেকগুলো পণ্যের দাম নি¤œমুখী। কিন্তু আমাদের দেশে সেগুলোর প্রতিফলন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। গত বছরের মার্চ থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত অনেক পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও তার প্রতিফলন আমাদের দেশে দেখছি না।’
বিদেশি বিনিয়োগেরও খুব বেশি অগ্রগতি দেখা যায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এক সময় জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে অনেক প্রবৃদ্ধি দেখে শঙ্কিত হতাম, এখন আবার উল্টো দিকে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাপকভাবে ঋণ নিচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৫১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। কিছু কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোর বাইরে আবার টাকার সরবরাহ বাড়ছে। বাজারে এক ধরনের অনিশ্চয়তা লক্ষ্য করছি। সুশাসনের অভাব রয়েছে। আইএমএফ থেকেও ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের কথা বার বার বলা হচ্ছে।
এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তৌফিক ইসলাম খান বলেন, ‘বর্তমান দেশের অর্থনীতিতে একটি ঝড় বইছে। এ ঝড় মোকাবিলা এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এখন যে সংষ্কার করতে বলছে, আমরা এই সংস্কারের কথাগুলো অনেক আগে থেকে বলে আসছি। শুধু সংস্কার করলেই হবে না প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপও নিতে হবে।
মাছ মাংস ছাড়াই চার সদস্যের পরিবারের ব্যয় ৭ হাজার টাকা: রাজধানী ঢাকায় চার সদস্যের একটি পরিবারের খাবারের পেছনে প্রতি মাসে খরচ হচ্ছে ২২ হাজার ৬৬৪ টাকা। আর খাদ্যতালিকা থেকে মাছ-মাংস বাদ দিয়ে ব্যয় দাঁড়ায় ৭ হাজার ১৩১ টাকা। কিন্তু নি¤œ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের যে আয় তা দিয়ে খাদ্যপণ্য কিনে টিকে থাকা কঠিন। তারা বলছে, চলতি বছরের ফেব্র–য়ারি মাস পর্যন্ত খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ২৫ শতাংশের বেশি।
সিপিডি জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে পণ্যের দাম বাড়ছে, তার চেয়েও বেশি হারে বাড়ছে দেশের স্থানীয় বাজারে পণ্যের দাম। বিশেষ করে চাল, আটা, চিনি, ভোজ্যতেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও স্থানীয় বাজারে সেই প্রভাব নেই। অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত পণ্যের দামও কারণ ছাড়া ঊর্ধ্বমুখী। এ ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি রয়েছে। লাগামহীন মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকেই খাদ্য ব্যয় কমিয়ে আনতে খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন আমিষ।