জাকারিয়া পলাশ: ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার পঞ্চম দিনেও অনেক বিদেশি স্টলে পণ্য ওঠেনি। পণ্যগুলো কাস্টমসে আটকে আছে বলে জানা গেছে। কাস্টমস কর্মকর্তারা নানা অজুহাতে ওইসব পণ্য আটকে রেখেছেন বলে অভিযোগ বিদেশি উদ্যোক্তাদের। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, অনিয়মের কোনো সম্ভাবনা নেই। বাণিজ্যমেলার কোনো পণ্য আটকে থাকলে তার পেছনে যথাযথ কারণ আছে বলে তাদের দাবি।
সূত্রমতে, ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় আগত বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো মেলার বেশ ক’দিন আগেই তাদের পণ্য বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মেলা শুরুর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও পণ্যগুলো ওঠেনি স্টল বা প্যাভিলিয়নে।
মেলার বিভিন্ন স্টল ও প্যাভিলিয়নে বিদেশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারত ও জাপানের পণ্য কাস্টমস জটিলতা শেষ করে মেলায় পৌঁছাতে পারেনি। এদিকে পণ্য সরবরাহে বিলম্বের কারণে ওইসব বিদেশি পণ্যের বেচাকেনা ও প্রদর্শন ব্যাহত হচ্ছে। তবে তুরস্কের কার্পেটসহ ভারী পণ্যগুলো মেলায় এসেছে যথাসময়ে। থাইল্যান্ড দূতাবাসের উদ্যোগে সাজানো তিনটি স্টলেও ভালো সমাগম হয়েছে থাইপণ্যের। বাংলাদেশি বিভিন্ন আমদানিকারক থাইল্যান্ড থেকে ওইসব পণ্য আমদানি করেছেন।
মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান ইপিবির তথ্যমতে, এ বছর মেলায় ভারত থেকে ১৪টি প্যাভিলিয়ন ও স্টল নেওয়া হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, ভারতীয় প্যাভিলিয়ন ও স্টলগুলোর অধিকাংশই নিয়েছেন ভারতের কাশ্মীরি ব্যবসায়ীরা। এছাড়া পাঞ্জাব ও দিল্লি থেকে কিছু ব্যবসায়ী এসেছেন। কাশ্মীরি ব্যবসায়ীরা হাতেবোনা শাল, চাদর, উলের পণ্য, পোশমিনা শাল, ওড়নাসহ বিভিন্ন পোশাক নিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশে এসব পণ্যের বিপুল চাহিদা থাকলেও এবার বেচাকেনা তেমন শুরু করতে পারেননি।
কাশ্মীর থেকে এবার প্রায় ৭০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কাশ্মীরি ব্যবসায়ী ও জম্মু-কাশ্মীর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সদস্য নাজির আহমাদ শেয়ার বিজকে জানান, ‘আন্তর্জাতিক মেলায় বিদেশি অংশগ্রহণকারীদের কাস্টমসে নানা ধরনের মুশকিল মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার চাইলে মেলায় বিদেশিদের অংশগ্রহণ সহজ করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য উদ্যোগের কথা শুনেছি। কিন্তু আমাদের কাছে কাশ্মীরি পণ্যের ওপর বিপুল অঙ্কের অর্থ চাওয়া হচ্ছে।’
আরেক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, তিনি সমুদ্রপথে কলকাতা থেকে পণ্য পাঠিয়েছেন এক মাস আগেই। ডিসেম্বরের ১৯ তারিখে সেগুলো চট্টগ্রামে আসে। কিন্তু মেলা শুরুর এক সপ্তাহ পরও তা খালাস করা যায়নি।
জাহিদ মীর নামে অপর এক ব্যবসায়ী জানান, তিনি ৫০ লাখ টাকা মূল্যের কাশ্মীরি শাল ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। এর মধ্যে ৩০ লাখ টাকার পণ্য অর্থ দিয়ে ছাড়ানো হয়েছে। বাকি পণ্য এখনও পাননি। পণ্যবাহী বিমানে প্রতি কেজিতে ৫৫০ টাকা পরিশোধ করেছেন কাস্টমসে। সব মিলে তিনি ১১ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন বলে জানান।
অপর একজন জানান, কলকাতা থেকে কার্গো বিমানে পণ্য ঢাকায় আনতে প্রতি কেজিতে ৬৫০ টাকা করে চাওয়া হয়েছে কাস্টমস থেকে। তারা কয়েকজন ব্যবসায়ী মিলে প্রায় ১০ হাজার কেজি পণ্য পাঠিয়েছেন। কিন্তু তারা এত টাকা দিতে চাচ্ছেন না।
এদিকে সমুদ্রপথে ১০০টি বাক্সে পণ্য পাঠিয়ে তার ১০টি বাক্স খুঁজে পাননি বলে অভিযোগ করেছেন আমিন ভাট। তার অভিযোগ, কাস্টমস কর্মকর্তারা সঠিকভাবে পণ্য খালাস করছেন না। তারা নানাভাবে হয়রানি করছেন।
ওইসব ব্যবসায়ী জানান, তারা আসার সময় লাগেজ হিসেবে কিছু পণ্য নিয়ে এসেছিলেন। সেগুলো বিভিন্ন স্টলে ভাগ করে বিক্রি শুরু করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ পণ্য কাস্টমসে পড়ে আছে। আকাশপথে আসা পণ্যের জন্য প্রতি কেজি ৬৫০ টাকা ও সমুদ্রপথে আনা পণ্যে প্রতি কেজি ৪৫০ টাকা হারে কাস্টম চার্জ চাওয়া হয়েছে। তারা দাবি করছেন, এটা নিয়মবহির্ভূত। এত টাকা দিলে মেলায় তাদের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। ফলে ক্রেতাদের পক্ষে ওইসব পণ্য কেনা সম্ভব হবে না বলে উল্লেখ করেন তারা।
এদিকে কাশ্মীরী পণ্য ছাড়াও জাপানি প্যাভিলিয়নে প্রদর্শন করা একমাত্র পণ্যটিও কাস্টমসের বাধার কারণে মেলায় ঢুকতে পারেনি এখনও। সূত্রমতে, ‘পোকারি সোয়েট’ নামে একটি প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি এনার্জি ড্রিংকস কোম্পানি ওই প্যাভিলিয়নটি নিয়েছে। স্যালাইনের বিকল্প হিসেবে ক্লান্তি নিরোধক এবং জাপানের শীর্ষ পানীয় বলে পণ্যটির বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয়েছে। ওই প্যাভিলিয়নের বিক্রয়কর্মী শেয়ার বিজকে জানান, পণ্যটি বাণিজ্যমেলার মাধ্যমেই বাংলাদেশে বাজারজাত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মেলায় এর প্রতিটি ক্যানের মূল্য ১০০ টাকা করা হয়েছিল। কিন্তু সিংহভাগ পানীয় ক্যান কাস্টমসে আটকে আছে। ফলে মেলায় এখন পণ্যটি বিক্রি করা হচ্ছে না। একান্ত কেউ পরখ করতে চাইলে তার কাছ থেকে মূল্য নেওয়া হচ্ছে ১২০ টাকা।
কাস্টমসের বিষয়ে এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে মেলা প্রাঙ্গণে স্থাপিত কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট সংক্রান্ত অফিসের দায়িত্বে নিয়োজিত রাজস্ব কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কাস্টমসে পণ্য আটকে থাকার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। ব্যবসায়ীরা তাদের এলসির কপি, প্যাকেজিং তালিকা, পণ্যের কোড নাম্বারসহ সরবরাহ করেছেন কি না, তা নিশ্চিত হতে হবে।’ এ বিষয়ে ‘কাস্টমস অফিসে যোগাযোগের’ পরামর্শ দেন তিনি।
জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কাস্টমসকে আগে থেকে জানালে আমাদের কাস্টমস কমিশনাররা সাধারণত সেগুলোকে ফার্স্টট্রাকভুক্ত করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খালাসের ব্যবস্থা করেন। এটা নির্ভর করবে কোন দেশ থেকে পণ্য কীভাবে কোন বন্দর দিয়ে এসেছে, তার ওপর। স্থলপথে এলে বেনাপোল, জলপথে এলে চট্টগ্রাম ও মোংলা এবং আকাশপথে এলে ঢাকা কাস্টমস কর্মকর্তারা বিষয়টি দেখবেন।’
এদিকে কাস্টমস সমস্যা ছাড়াও নানা অসুবিধার কথা জানিয়েছেন বিদেশি ব্যবসায়ীরা। নেপালি ব্যবসায়ী পুষ্পরতœ জানান, ‘মেলায় বিভিন্ন দেশের জন্য আলাদা রকমের খাবার পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে এসে ঝাল ও মশলাযুক্ত খাবার খেয়ে গ্যাস্ট্রিক সমস্যায় ভুগছি।’
অপর এক ভারতীয় ব্যবসায়ী জানান, বিভিন্ন স্টলের বিদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য বার বার মেলায় প্রবেশের পরিচয়পত্র (পাস) দেওয়া হয়নি। ফলে প্রতিবার প্রবেশের জন্য বিদেশি ব্যবসায়ীদের আলাদাভাবে টিকিট কিনতে হচ্ছে।