প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

বান্দরবানে ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসবে মেতেছে পাহাড়ীরা

রঙ লেগেছে পাহাড়ে, ফানুসের আলোয় বর্ণিল আকাশ

বান্দরবানে ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসবে মেতে উঠেছে মারমা জনগোষ্ঠী’সহ পাহাড়ীরা


প্রতিনিধি, বান্দরবান : বান্দরবানে ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসবে মেতে উঠেছে মারমা জনগোষ্ঠী’সহ পাহাড়ীরা। রঙ বেরঙের শতশত ফানুসের আলোয় বর্ণিল এখন বান্দরবানের রাতের আকাশ। যেন রং লেগেছে পাহাড়ে।

“ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে, গো ক্রোছোবায়া পাঁইনা পাপকনা, মারমা ভাষায় এই গানের সুরের তালে মাতাল হয়ে উঠেছে পাহাড়ী পল্লীগুলো। মারমা তরুন-তরুনীদের মুখে মুখে শোভাপাচ্ছে এখন গানের এই সুর। তিন মাস বর্ষাবাস (উপুস) থাকার পর বান্দরবান জেলায় ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসবে মেতে উঠে পাহাড়ের জনগোষ্ঠীরা।

ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে হচ্ছে মারমা জনগোষ্ঠীর অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। উৎসব’কে ঘিরে বান্দরবান জেলায় পাহাড়ী পল্লীগুলো সেজেঁছে নতুন সাঁজে। চলছে নানান অনুষ্ঠানমালাও। এই উৎসবে আকাশে উড়ানো হয় রঙ বেরঙের শতশত ফানুস বাতি। ফানুসের আলোয় এখন বর্ণিল হয়ে উঠেছে বান্দরবানের রাতের আকাশ।

প্রচলিত আছে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধ এই আশ্বিনী পূর্নিমায় তার মাথার চুল আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিল। তাই আশ্বিনী পূর্নিমার এই তিথিতে আকাশে উড়ানো হয় রঙ বেরঙের ফানুস বাতি। এই উৎসবে পাহাড়ের মারমা জনগোষ্ঠীরা নিজস্ব সামর্থ অনুযায়ী ফানুসবাতি বানিয়ে আকাশে উড়িয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধকে স্মরণ করা হয়।

মারমা জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস: আকাশে উঠার আগেই যে ব্যাক্তির ফানুস মাটিতে পড়ে যায়, তাকে পাহাড়ীরা পাপী লোক হিসেবে চিহ্নিত করে। ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসবে ফানুস উড়িয়ে পাহাড়ীরা নিজেদের পাপ মোচন ও পাপী মানুষ খুঁজে বের করে। একারণে ফানুস আকাশে উড়ানোর সময় পাহাড়ীরা মারমা ভাষায় “সাও দো” “সাও দো” বলতে থাকে। অর্থাৎ শুভ মুক্তি।

উৎসবে মাতোয়ারা মারমা তরুনী থুইয়ে থুই মারমা ও একেনু মারমা বলেন, ওয়াগ্যোই পোয়ে মারমা জনগোষ্ঠীর প্রধান ধর্মীয় উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই উৎসবে আমরা বৌদ্ধ বিহারে মানবজাতীর শান্তি কামনা এবং অন্ধকার ও অশুভশক্তি দূর করতে হাজারো প্রদ্বীপ জ্বালায়। ধর্ম দেশনা ও প্রার্থনা করা হয়। উৎসবে সকাল বেলায় দূরদূরান্ত থেকে বিহারের ধর্মীয় গুরু ভিক্ষুদের জন্য তরুন-তরুনী, শিশু-কিশোর এবং নারী-পুরুষেরা মিলে ছোয়াইং নিয়ে যায়। পূন্যের জন্য ভিক্ষুদের মাঝে দান করি মিষ্ঠি খাবার, নগদ টাকা এবং কাপড়।

তরুনী উমেচিং ও রিয়া মারমা বলেন, উৎসবে আমরা অনেক মজা করি। পাহাড়ী পল্লীগুলোতে রাতব্যাপী চলে পিঠা তৈরির প্রতিযোগীতা। তরুন-তরুনীরা দলবেধেঁ বসে হরেক রকমের তৈরি করা পিঠা ধর্মীয় গুরু এবং পাড়া-প্রতিবেশিদের বাড়িতে বাড়িতে বিতরণ করি। চলে নিজস্ব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালাও। নাচে-গানে উৎসব মাতিয়ে তোলেন পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর শিল্পী তরুন-তরুনীরা। রাজবাড়ি মাঠে চলে সুর আর ছন্দেও এই প্রতিযোগীতা। উৎসব দেখতে ঢল নামে পাহাড়ী-বাঙ্গালী হাজারো মানুষের। বেড়াতে আসা পর্যটকেরাও ভীড় জমান উৎসবে।

ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসব উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক শৈটিং ওয়াই মারমা বলেন, উৎসবের মূল আকর্ষণ হচ্ছে মঙ্গল রথযাত্রা। স্বর্গীয় সুন্দর দেবতার মুর্তির আদলে তৈরি করা বিশাল আকৃতির ময়ুর রথের উপর একটি বুদ্ধমূর্তি স্থাপন করে রথটি রশি দিয়ে টেনে টেনে পুরো জেলা শহর ঘোরানো হয়। এসময় বৌদ্ধ ধর্মের নর নারীরা মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বুদ্ধ মূর্তিকে। রাতের এ রথযাত্রা দেখার জন্য রাস্তার দুপাশে ভীড় জমে। ফানুস উড়ানোর মাধ্যমে আরম্ভ হওয়া ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে উৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে সোমবার মধ্যরাতে সাঙ্গু নদীতে মঙ্গলরথ বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে। তবে মূল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেও পাহাড়ী পল্লীগুলোতে উৎসব চলবে মাস জুড়েই।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জেলা হচ্ছে বান্দরবান। এখানে উৎসব মানেই হচ্ছে পাহাড়ী-বাঙ্গালী ভিন্ন ভাষাভাষির প্রায় চৌদ্দটি জনগোষ্ঠীর মানুষের মিলনমেলা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন ধর্ম যার যার, কিন্তু উৎসব হচ্ছে সবার। পাহাড়ের উৎসবে জাতীধর্ম বর্ণ কোনো ভেদাভেদ নেই। এই আশ্বিনী পূর্ণিমায় গৌতম বুদ্ধ তার মাথার চুল আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিল। তাই বুদ্ধের স্মরণে এই উৎসবে আকাশে উড়ানো রঙ বেরঙের শতশত ফানুস বাতি। পাহাড়ের বৈচিত্রময় এই উৎসব দেখতে ভীড় জমান দেশী-বিদেশী পর্যটকেরাও। এটি পাহাড়ের প্রাণের উৎসবে পরিনত হয়। ফানুস ও হাজারো প্রদ্বীপ প্রজ্জলনের আলোয় দূর হোক অন্ধকার ও অশুভ শক্তি। শান্তিময় জীবন হোক বিশ্ববাসীর এই কামনা করি।