প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

বাড়তি বিনিয়োগের আশ্বাসে নিয়মিত থেকে খেলাপি গ্রাহক

যে ব্যক্তির ঘটনা এখানে উল্লেখ করব, তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের বিনিয়োগ গ্রাহক। ওই ব্যাংক তাকে যে পরিমাণ বিনিয়োগ অনুমোদন দিয়েছে, তার অঙ্কও মোটামুটি বড়। ব্যাংকটি গ্রাহকের ব্যবসায়িক সামর্থ্য বিবেচনায় রেখেই অনুমোদন করেছিল বিনিয়োগ সীমা। বলা ভালো, সহযোগী জামানত হিসেবে যে সম্পত্তি তিনি বন্ধক দিয়েছেন, এর ভিত্তিতে নিয়ম অনুযায়ী যে পরিমাণ বিনিয়োগ সুবিধা তাকে দেওয়া যায়, সেই পরিমাণই দিয়েছে ওই ব্যাংক। ব্যবসার আকার বৃদ্ধির সঙ্গে নগদ অর্থের চাহিদাও বাড়ে। ওই ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল। সেজন্য গ্রাহক ভাবলেন, তার বিনিয়োগ সীমা বাড়ানো দরকার। ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানালেনও। তাদের পক্ষ থেকে বলা হলো, বিনিয়োগ সীমা বাড়াতে হলে প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত জামানতও দিতে হবে। এ প্রস্তাবে তিনি রাজি হলেন না।

তিনি কেন রাজি হননি, তা জানা গিয়েছিল আরও পরে। আলোচনার এক ফাঁকে তিনি বলেছিলেন, অমুক ব্যাংক যদি এই পরিমাণ জামানত দিয়েই আমার কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ দিতে পারে, তাহলে আপনাদের সমস্যা কোথায়? যত দূর জেনেছি, বর্তমান ব্যাংকের সঙ্গে তার লেনদেন ছিল প্রায় ছয় বছর। বিনিয়োগ গ্রাহক হিসেবে তার পারফরম্যান্সও ছিল মোটামুটি। কোনো গ্রাহক যখন বিনিয়োগ সীমা বাড়ানোর দাবি নিয়ে কর্মকর্তাদের কাছে এ ধরনের কথা বলেন, তখন এর মধ্য দিয়ে তিনি কী বার্তা দিতে চান, তা ব্যাংকারের বুঝতে কষ্ট হয় না। দেখা গেল, তিনি ব্যাংকের পাওনা নির্ধারিত তারিখে পরিশোধ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে বিরত রাখলেন। কারণ, এক. এ ব্যাংক থেকে নতুন করে সুবিধা নেওয়ার ইচ্ছা তার আর ছিল না। দুই. এটা করলে ব্যবসায়ের নগদ অর্থপ্রবাহে ঘাটতির আশঙ্কা ছিল। ফলে একপর্যায়ে তার বিনিয়োগ হিসাবের মোট স্থিতির প্রায় ৭৫ শতাংশই পরিণত হলো খেলাপিতে।

কোনো গ্রাহকের বিনিয়োগ হিসাব খেলাপিতে পরিণত হলে নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংক তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেটা হতে পারে ফোনে, পরিদর্শনে গিয়ে কিংবা চিঠি দিয়ে। ব্যাংকটির কর্মকর্তারা ওই গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে একপর্যায়ে তিনি জানালেন, ঋণ অনুমোদনের জন্য এরই মধ্যে তিনি আবেদন করেছেন আরেকটি ব্যাংকে। ওখান থেকে টাকা পেলেই আগের দেনা পরিশোধ করবেন। বস্তুত বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়া কিছুটা সময়সাপেক্ষ। অনুমোদন ক্ষমতা শাখায় না থাকলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাস হয়ে আসতে কিছুটা সময় লাগে সঙ্গত কারণেই।

ওই গ্রাহকের ক্ষেত্রে যেটি ঘটেছিল তা হলো, দ্বিতীয় যে ব্যাংকে তিনি ঋণ অনুমোদনের আবেদন করেছিলেন, সেখানে বেশ কয়েক মাস সময় লাগল। এরই মধ্যে তার আগের ব্যাংকের খেলাপি বিনিয়োগ পরিণত হলো শ্রেণিবদ্ধ বিনিয়োগে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা হলো, খেলাপি গ্রাহককে কোনো ব্যাংক নতুনভাবে ঋণ দিতে পারবে না। ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) মাধ্যমে বিষয়টি নজরে আসায় দ্বিতীয় ব্যাংকও তখন তাকে অনুমোদন দিতে রাজি হলো না। তখন ওই গ্রাহক আবার ফিরে এলেন প্রথম ব্যাংকে, এই আবেদন নিয়ে কোনোভাবে তার বিনিয়োগসীমা নবায়ন করা যায় কি না। কর্মকর্তারা তখন যথারীতি তাকে জানালেন, শ্রেণিবদ্ধ বিনিয়োগ সমন্বয় করলেই কেবল এ আবেদন গ্রহণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে।

বলা ভালো, বিনিয়োগ সুবিধার ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য প্রথম ব্যাংকের কর্মকর্তারা শুরুতেই তাকে ফাইল নবায়নের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু বেশি অর্থ পাওয়ার আশায় তিনি তা করেননি। আর এ থেকেই শুরু হলো তার বিপদ। বাস্তবতা হলো, এ ধরনের বিপদে যে তিনি পড়তে যাচ্ছেন, তা কল্পনা করেননি কোনোভাবেই। বস্তুত ব্যাংকিং খাতে এরকম ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে। সব ব্যাংকের হাতে প্রচুর পরিমাণ অলস টাকা। আর ব্যাংকারের ওপর তাগাদা রয়েছে বিনিয়োগ টার্গেট পূরণের। এভাবে বাড়তি বিনিয়োগ অনুমোদনের আশ্বাস দিয়ে গ্রাহক টানতে গিয়ে শুধু ব্যাংক নয়, সংশ্লিষ্ট গ্রাহকও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে।

উল্লিখিত ঘটনা গভীরভাবে খেয়াল করলে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়। প্রথমত, প্রথম ব্যাংক গ্রাহকের বিনিয়োগ সীমা বৃদ্ধিতে রাজি ছিল। এজন্য অতিরিক্ত জামানতও চেয়েছিল। দ্বিতীয় ব্যাংক একটু ছাড় দিয়েছিল এক্ষেত্রে। কারণ বাড়তি ঋণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে গ্রাহককে নিজ ব্যাংকে নেওয়াই ছিল তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য।

দ্বিতীয়ত, সমস্যা ছিল গ্রাহকের। যে পরিমাণ টাকা ফান্ডেড লায়াবিলিটি থাকে ট্রাস্ট রিসিপটের (টিআর) মাধ্যমে বিনিয়োগ দেওয়া হলে সে পরিমাণ ব্যবসায়িক সম্পদ দেখতে চায় ব্যাংক। সেটা যদি না থাকে কিংবা ওই সময় গ্রাহক পাওনা পরিশোধ করতে অসমর্থ হন, তখন কর্মকর্তাদের মনে নতুন প্রশ্নের উদয় হয়, তিনি কি তাহলে ব্যবসায়ের অর্থ নিয়ে যাচ্ছেন ভিন্ন কোনো খাতে? খুব সৎ না হলে কোনো গ্রাহক কিন্তু এ প্রশ্নের সোজাসুজি উত্তর দিতে চান না।

তৃতীয়ত, বড় অঙ্কের ঋণ আবেদন প্রক্রিয়াকরণের বিষয়টিও এখানে এসেছে সমস্যা হিসেবে। যে অঙ্কের ঋণ অনুমোদন ক্ষমতা শাখায় নেই, সেসব ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে বেশি। প্রস্তাবটি পাস হতে কত সময় লাগবে, সে ব্যাপারে নিশ্চয়তা যেমন থাকে না, তেমনি নির্দিষ্ট থাকে না সময়। এর মধ্যে একদিকে গ্রাহকের পক্ষ থেকে আসে তাগাদা এবং অন্যদিকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ডকুমেন্টারি নানা রকম চাহিদা ও জিজ্ঞাসার জবাব দিতে শাখার কর্মকর্তারা থাকেন উভয় সংকটে। এ পরিস্থিতিতে গ্রাহকের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী বাড়তি অঙ্কের ঋণ অনুমোদন ও অর্থ ছাড় হলে তো ভালো। নইলে ঘটে উদ্ভূত পরিস্থিতি।

প্রশ্ন উঠতে পারে, উদ্ভূত পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে দায় আসলে কার গ্রাহক না ব্যাংকের? এ প্রশ্নের উত্তর সরাসরি দেওয়া সহজ নয়। কোনো এলাকায় ব্যাংকের নতুন শাখা খোলা হলে এ ধরনের সমস্যা হয় বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা আছে আনুপাতিক হারে শহরাঞ্চলের বাইরে শাখা খোলার। প্রান্তিক মানুষের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ত্বরান্বিত করার জন্যই দেওয়া হয়েছে এ নির্দেশনা। বাস্তবতা হলো, উপজেলা ও ছোট জেলা শহরগুলোয় ব্যবসায়ীর সংখ্যা হাতে গোনা। নতুন শাখা খোলা হলে সেখানে কৌশলে অন্য ব্যাংকের গ্রাহক আনা ছাড়া উপায় কী?

এখানে একটি বিষয় মনে রাখা ভালো হবে যে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে গ্রাহকরাই সাধারণত ক্ষতিগ্রস্ত হন বেশি। কেননা উল্লিখিত ঘটনায় প্রথম ব্যাংক তার খেলাপি গ্রাহকের বিরুদ্ধে নিয়ম অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা নেবে, এটাই স্বাভাবিক। এ পদক্ষেপ নেওয়া না হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকেও তোলা হবে প্রশ্ন। তবে এমন ঘটনায় গ্রাহক যদি কোনোভাবে অর্থের সংস্থান করে পাওনা পরিশোধ করতে পারেন তো ভালো। ব্যবসায়ও ফেরার সুযোগ থাকবে তার। কিন্তু যাদের বাড়তি ঋণের আশ্বাস এ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী, তিনি কি পারবেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে? পারবেন না। কারণ ব্যাংকের পক্ষ হতে এরকম লিখিত প্রতিশ্রুতি কোনো ব্যাংক যত দূর জানি তার গ্রাহককে দেয় না।

পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অংশগ্রহণকারী সব পক্ষের মধ্যেই প্রতিযোগিতা বিরাজমান। ব্যাংক ব্যবস্থায় এটা থাকে প্রতিষ্ঠান ও গ্রাহক উভয়ের মধ্যে। স্বভাবতই যিনি যেখানে বেশি সুবিধা পাবেন, সেখানে যাবেন। কথা হলো, গ্রাহকের ব্যাপারে ব্যাংক কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন যদি সঠিক না হয়, তারা যদি গ্রাহকের ঋণের চাহিদা ঠিকভাবে পরিমাপ করতে না পারেন, তাহলে এমন সমস্যা বাড়বে। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে এ ধরনের টেকনিক্যাল সমস্যাও হতে পারে খাতটির জন্য হুমকি।

সমাজে কিছু মানুষ এখনও আছেন, ব্যাংকঋণকে তারা দেখেন নেতিবাচক দৃষ্টিতে। তাদের ধারণা, এমন প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিলে মানুষ সাধারণত বিপদে পড়ে। এজন্য বিনিয়োগ সুবিধা নেওয়ার প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকে আসেন না অনেকে। মফস্বল শহর বা গ্রামাঞ্চলে সমস্যা আরও বেশি এ কারণে যে, এখানে কারও বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হলে অল্প সময়ের মধ্যে আশপাশের মানুষ তা জেনে যায়। আরেকটি সত্য হলো, ঋণখেলাপিকে সমাজের কেউ ভালো চোখে দেখে না। যে গ্রাহকের ঘটনা এখানে উল্লেখ করলাম, তার উদ্দেশ্য যে অসৎ ছিল, সে কথা বলবো না। ব্যাংক কর্মকর্তারা যখন তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কিংবা বাসায় যান, শুনেছি আশপাশের লোকেরা তাকিয়ে থাকে উৎসুক দৃষ্টিতে। অবস্থার পরিবর্তন না হলে কয়েক দিন পরে তার কাছে যাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা। এটা ক্ষতিগ্রস্ত করবে তার ভাবমূর্তি। কিন্তু যে কারণে তাকে এ সমস্যায় পড়তে হলো, সেটা তিনি কয়জনকে বুঝিয়ে বলতে পারবেন?

 

ব্যাংক কর্মকর্তা

zahirul.duÑgmail.com