নিজস্ব প্রতিবেদক: শহরের ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে পড়ছে। এটি ধারাবাহিকভাবে চাপ তৈরি করছে, যা শহরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গরিবের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ইকোনমিস্ট ফোরাম (বিইএফ)।
গতকাল মিরপুরে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে বিইএফ আয়োজিত ‘উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠান: নগরায়ন ও ভূমি উন্নয়নে প্রয়োজন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান’ শীর্ষক তৃতীয় কনফারেন্সের মূল বক্তব্যে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান।
আতিউর রহমান বলেন, শিল্প উন্নয়নের জন্য গ্রাম থেকে দরিদ্রদের শহরে নিয়ে আসা হয় সস্তা শ্রমশক্তি হিসেবে। এতে শহরের ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে, যা ধারাবাহিকভাবেই হচ্ছে। এটি শহরের ব্যবস্থাপনা উন্নয়নকে কঠিন করে তুলছে, যা শহরে গরিবের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে। কিন্তু এ জনশক্তিকে যদি দক্ষ করে তোলা যায় এবং বাসস্থানের উন্নয়ন ঘটানো যায়, তাহলে এ শ্রমশক্তি দেশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে। এ জনশক্তির জন্য পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবার অভাব পূরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে উন্নয়ন ঘটাতে হবে। মনোযোগ দিতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পে।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ঢাকার বাইরের বিভিন্ন শহরে ও আধা শহরে নানা ধরনের ক্লাস্টার রয়েছে। যেখানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক এসএমই রয়েছে। গ্রাম থেকে এসব শহরে আসা অসংখ্য উদ্যোক্তা রয়েছে, যারা বিভিন্ন ধরনের অর্থায়ন সংগ্রহ করে নিজেরা কিছু একটা করছে। একটা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে। যেখানে তাদের চাকরির অনিশ্চয়তা নেই। এটা একটা বিকল্প হিসেবে উল্লেখ করা যায়। এভাবে করে আরও বড় পরিসরে মানুষগুলোকে কাজে লাগাতে পারলে তখন ঢাকার ওপর চাপ কমতে থাকবে।
এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দ্রুত প্রযুক্তির বিস্তার, জিডিপি বৃদ্ধির চাপ এবং বিশ্বব্যপী জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করে এগোতে হলে কাক্সিক্ষত মানের শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। এর কোনো বিকল্প নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনের ন্যায়পরায়ণতা, দক্ষতা ও সক্ষমতা এবং উপযুক্ত আর্থিক কাঠামোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন।
সঞ্চালক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. খলীকুজ্জামান। তিনি বলেন, আমরা এসএমইর বিভিন্ন ক্লাস্টারে বিনিয়োগের কথা বলি। গ্রামে যে এসএমই ঋণ দেওয়া হয়, তা নগণ্য। সেটা আসলে প্রকৃত বিনিয়োগ হয় না। প্রচুর ক্লাস্টার রয়েছে যেখানে ৫, ৭ বা ১০ লাখ টাকা দিলে তারা দু-এক বছরের মধ্যে ভালো করে দাঁড়াতে পারবে। একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড়াবে। তাহলে সেখানে কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এভাবে করতে পারলে প্রচুর পরিমাণ এন্টারপ্রাইজ দাঁড়াতে পাড়বে।
এটা আমাদের ভাবা উচিত যে তার আসলে কত টাকা প্রয়োজন। কারও যদি এক লাখ টাকা প্রয়োজন থাকে আর তাকে আমরা যদি ১০ হাজার টাকা দিই, সে টাকা তো তিনি কোনো কাজ করতে পারবেন না। তিনি সেটা খেয়ে ফেলবেন। তাই তার প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ দিতে পারলেই প্রকৃত উন্নয়নটা ঘটবে। যেটা আমরা চাই।
তিনি মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বেশি চার্জ নেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতি হাজারে খরচ হচ্ছে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা। এরপর প্রতি হাজারে দ্বিগুণ হতে থাকে। অথচ ভারতে ১০ হাজারে খরচ মাত্র আড়াই রুপি। ২০ হাজার পর্যন্ত পাঁচ রুপি। এখানে মনোপলি হচ্ছে। একটা-দুটো প্রতিষ্ঠান ডমিনেট করে যাচ্ছে। এটা ঠিক নয়। এটাকে কমানো যেতে পারে। একটা যৌক্তি চার্জ নির্ধারণ করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে এ সেবা প্রদান করে সব প্রতিষ্ঠানকে প্রতিযোগিতা করার জন্য একই ধরনের জায়গা দিতে হবে।
আর ইনক্লুশন বলতে আমরা যে জিনিসটা বোঝাতে চাই সেটা আসলে কী। কাউকে তার অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৫০০ টাকা পৌঁছে দিলাম। সে সেটা নিয়ে বাজার করে খেয়ে ফেললো। এটাই কি ইনক্লুশনের শেষ কথা? সত্যিকার অর্থে টাকাটা কাজে লাগিয়ে অর্থাৎ টাকার প্রাপ্ত টাকাটার যর্থার্থ ব্যবহার বাড়াতে পারলে হবে ইক্লুশন। তার যদি টাকা বাড়তে থাকে তিনি নিয়মিতভাবে চ্যানেলে যুক্ত হয়ে পড়বে।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান তার বক্তব্যে বলেন, আমাদের মূল সমস্যাটা বেশি জনসংখ্যাকে কেন্দ্র করে নয়। এটা হচ্ছে সুশাসনের প্রশ্ন। সুশাসনে আমাদের বিস্তর সমস্যা রয়েছে। আর দক্ষ জনশক্তির সংকট রয়েছে। আমরা আমাদের লোকদের প্রকৃত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারলে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়বে। বেড়ে যাবে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি।
আমারা যা-ই করি, যা-ই বলি না কেন শেষমেশ সেটা ঢাকাকেন্দ্রিক থেকে যায়। কিন্তু ঢাকা নিয়ে কোনো কিছু চিন্তা করেও আমরা পুরো বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে পারি না। ২০০৪ সালে আমাদের ঢাকায় ঘণ্টায় গড়ে ২১ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দেওয়া যেত। ২০১৬ সালে সেটা ৬ থেকে সাড়ে ৬ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। শুধু ঢাকা নিয়ে চিন্তা না করে আমাদের উচিত মফস্বলের বিষয়টি চিন্তা করা। সেখানকার পরিবেশ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে। সেখানে যদি পরিবেশের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হয়, মিল কারখানা গড়ে উঠে তাহলে লোকজন আর ঢাকায় আসবে না। তারা সেখানেই কাজ করবে।
অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী পর্বে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ, বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরি এবং পিআরআই অপারেশন ডিরেক্টর ড. খুরশিদ কামাল।