প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

বিএফআইইউ যেন বিদেশ ভ্রমণের আলাদিনের চেরাগ!

মাসুম বিল্লাহ: আরব্য রজনীর জনপ্রিয় গল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। এ প্রদীপে ঘষা দিলে বেরিয়ে আসত এক দৈত্য। দৈত্যের কাছে আলাদিন যা আবদার করতেন, দৈত্য তা-ই এনে হাজির করত আলাদিনের সামনে। দেশ থেকে অর্থ পাচার প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) যেন এর কর্মকর্তাদের কাছে একপ্রকার আলাদিনের প্রদীপ। কেননা এই আশ্চর্য প্রদীপের ছোঁয়ায় কর্মকর্তারা সহজেই পেয়ে যান বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ। অর্থ পাচার কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়, সে বিষয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় করে এসব বিদেশ সফরের ব্যবস্থা করা হলেও তা থেকে অর্জন নেই বললেই চলে। কারণ, বিএফআইইউ’র কর্মকর্তারা তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে এখনও পর্যন্ত শনাক্ত করতে পারেননি যে, দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়। বিষয়টি তারা স্বীকারও করেছেন।

জানা যায়, ২০১২ সালে মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন অ্যাক্ট প্রণীত হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক রূপ পায় বিএফআইইউ। আইন অনুযায়ী এটি একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির মূল দায়িত্ব হলো দেশ থেকে যে অর্থ পাচার হয়, তা প্রতিরোধ করা। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ১০ বছর অতিবাহিত হলেও সংস্থাটি অর্থ পাচার প্রতিরোধে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। তবে অর্থ পাচার প্রতিরোধ বা পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে সফলতা দেখাতে না পারলেও সংস্থাটির কর্মকর্তারা বিদেশ সফরে বেশ সফলতা দেখিয়েছেন।

বিএফআইইউ’র কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের বিভিন্ন আদেশ (জিও) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কামাল হোসেন নামের একজন কর্মকর্তা অর্থ পাচার প্রতিরোধের বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ২০১২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ৩৫ বার বিদেশ সফর করেছেন। কামাল হোসেন এ সময়ে চারবার করে ভ্রমণ করেছেন ফ্রান্স, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া ভ্রমণ করেছেন দুইবার করে। এছাড়া একবার করে ভ্রমণ করেছেন কাতার, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, মরক্কো, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, নেপাল, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, যুক্তরাজ্য, মালদ্বীপ, মঙ্গোলিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সুইজারল্যান্ড। এর মধ্যে ২৭টি বিদেশ সফরের ব্যয়ভার বহন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাকিগুলোর ব্যয়ভার বহন করেছে আয়োজক সংস্থা ও অন্যান্য স্পন্সর।

মোহাম্মদ আব্দুর রব নামে আরেক কর্মকর্তা বিদেশ সফর করেছেন ২৩ বার। তার নামে জারি হওয়া বিদেশ ভ্রমণের আদেশগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তিনি অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স, ভুটান, যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইন, তাইপে, অস্ট্রিয়া, হংকং, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম ভ্রমণ করেছেন। এর মধ্যে ভুটান, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে একাধিকবার ভ্রমণ করেছেন। তার ২৩টি বিদেশ সফরের মধ্যে ১২টির খরচ বহন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাকিগুলোর ব্যয়ভার বহন করেছে আয়োজক সংস্থা ও অন্যান্য স্পন্সর।

আর মো. মাসুদ রানা নামে এক কর্মকর্তা বিদেশ সফর করেছেন ২১ বার। তিনি যেসব দেশ ভ্রমণ করেছেন তার মধ্যে রয়েছেÑমালয়েশিয়া, বেলজিয়াম, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, নেপাল, শ্রীলংকা ও জাম্বিয়া। এর মধ্যে কম্বোডিয়ায় চার বার, নেপালে তিন বার এবং মালয়েশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ায় দুইবার করে ভ্রমণ করেছেন। এসব ভ্রমণের মধ্যে ১৩টির ব্যয়ভার বহন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাকিগুলো আয়োজক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা বহন করেছে।

এর বাইরে যেসব কর্মকর্তা এক-দুইবার বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছেন তারা হলেনÑদেবপ্রসাদ দেবনাথ, মো. রাশেদ, একেএম রমিজুল ইসলাম,  মো. নজরুল ইসলাম, মো. ফেরদৌস কবির, ভাস্কর পোদ্দার, মোহাম্মদ নওশাদ আলী চৌধুরী, মো. ওমর শরীফ, মো. আজমল হোসেন, জাকির হোসেন চৌধুরী, তরুণ তপন ত্রিপুরা, একেএম নুরুন্নবী, মো. খায়রুল আনাম, জুয়াইরিয়া হক, মো. আল-আমিন রিয়াদ, মো. এস্কান্দার মিয়া,  মো. নাসিরুজ্জামানসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তা। এসব বিদেশ ভ্রমণ সম্পন্ন হয়েছে ২০১২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে। ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ কমে যায়। আর অর্থনৈতিক সংকটের কারণে গত এক বছরের মতো সময় ধরে সরকার কৃচ্ছ্রতার নীতি অনুসরণ করায় এখন বিদেশ সফর কম। এ দুই কারণ সংঘটিত না হলেও এ বিদেশ সফর আরও অনেক বেশি হতো বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

কর্মকর্তাদের এসব বিদেশ ভ্রমণ আয়োজনে কোটি কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় হয়েছে। কিন্তু বিদেশ ভ্রমণের মাধ্যমে অর্জিত অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান অর্থ পাচার রোধে কতটা ভূমিকা রেখেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে, সে বিষয়ে জানতে বিএফআইইউ’র প্রধান কর্মকর্তা মাসুদ বিশ্বাসকে ফোন করা হলে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বিএফআইইউর কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা একটু বেশি থাকা স্বাভাবিক। কারণ দাপ্তরিক প্রয়োজনেই তাদের এসব বিদেশ সফর প্রয়োজন হয়।’

বিএফআইইউ কর্মকর্তাদের ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নানা কৌতুকের জš§ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে বিএফআইইউ’র কর্মকর্তাদের নিয়ে যে কৌতুক সবার মুখে মুখে তা হলোÑসংস্থাটির কর্মকর্তারা এত ঘন ঘন বিদেশ যান যে, একটি বিদেশ সফর থেকে ফিরে এসে আরেকটি সফরে যাওয়ার মাঝে খুবই কম সময় তারা পান। এত কম সময়ের মধ্যে তারা লাগেজ গোছানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় পান না। এ জন্য সবসময় বিমানবন্দরে একটি লাগেজ রেডি করে রাখেন। যাতে করে একটি বিদেশ সফর থেকে ফিরে তৎক্ষণাৎ আরেকটি সফরে যাওয়ার জন্য সহজে ফ্লাইট ধরতে পারেন। বর্ণনাটি কৌতুকের মতো শোনালেও প্রকৃতপক্ষে বিএফআইইউ’র কর্মকর্তাদের মাসে একাধিক বিদেশ সফরের নজির রয়েছে। তাদের বিদেশ সফরে কোটি কোটি টাকা খরচ হলেও যে উদ্দেশ্যে তাদের বিদেশ পাঠানো হয়, সে উদ্দেশ্য সাধনে কর্মকর্তাদের কোনো আগ্রহই নেই বলেই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। ঘন ঘন বিদেশ সফরের সুযোগ থাকায় অনেকে বিএফআইইউতে পোস্টিং নেয়ার জন্য তদবির করে থাকেন। আর বিশেষ কিছু কর্মকর্তার ১০ বছরেরও অধিক সময় ধরে একই জায়গায় পদায়নের কারণে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন অ্যাক্ট বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৯ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ বিধিমালা জারি করা হয়। বিধিমালাটি বিশ্লেষণ করে জানা যায়, বিএফআইইউ’র একটি অনুমোদিত জনবল কাঠামো থাকলেও সেখানে সরাসরি জনবল নিয়োগ দেয়ার কোনো বিধান নেই। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রেষণের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের সেখানে নিয়োগ দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এর পাশাপাশি অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সংস্থা যেমন পুলিশের সিআইডি ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকেও কর্মকর্তাদের প্রেষণে নিয়োগ দেয়ার বিধান থাকলেও এখন পর্যন্ত কেবল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেই প্রেষণে কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর নিয়োগ পাওয়া এসব কর্মকর্তার বেশ কয়েক জন ১০ বছরের অধিককাল বিএফআইইউতে প্রেষণে কর্মরত রয়েছেন।

এসব কর্মকর্তা অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের নামে বারবার বিদেশ সফর করলেও সে অভিজ্ঞতা অর্থ পাচার রোধে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি বলেই প্রতীয়মান হয়েছে সম্প্রতি সংস্থাটির প্রধান কর্মকর্তার বক্তব্যে। প্রধান কর্মকর্তা মাসুদ বিশ্বাস কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, দেশ থেকে অর্থ পাচার হলেও তা ফেরানো সম্ভব নয়। এমনকি দেশ থেকে প্রতি বছর কী পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে, সে বিষয়েও তাদের কাছে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। এমন পরিস্থিতিতে বিএফআইইউ’র কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি উচ্চ আদালতও এ বিষয়ে জানার জন্য বিএফআইইউ কর্তাদের একাধিকবার তলব করেছেন। সেখানেও সংস্থাটি সদুত্তর দিতে পারেনি।