আতাউর রহমান: দেশের পুঁজিবাজারে স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলোর শেয়ারের প্ল্যাটফর্মে (এসএমই প্ল্যাটফর্ম) লেনদেন চলা ইউসুফ ফ্লাওয়ার মিলস লিমিটেডের শেয়ার নিয়ে কারসাজি চলছেই। প্রথমবার সার্কিট ব্রেকার না থাকার সুযোগ নিয়ে কয়েক ঘণ্টায় শেয়ারটির দর দুই হাজার টাকায় ওঠানো হয়। সেদিন লেনদেন শেষে শেয়ারটির দর ৫৯৪ টাকায় দাঁড়ায়। এতে দীর্ঘদিন উৎপাদন বন্ধ এবং পুঁজিবাজারে ওটিসি মার্কেট থাকা একটি কোম্পানির শেয়ার কীভাবে দুই হাজার টাকায় পৌঁছে এবং ৫০০ টাকার বেশি হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ফলে বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নজরে আসে। পরে যারা শেয়ারটির দর এমন অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়েছে, তাদের তলব করা হয় এবং ব্যাখ্যা নেয়া হয়।
কিন্তু বিএসইসির ব্যাখ্যা তলবের পরও থামেনি শেয়ারটি নিয়ে কারসাজি। কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) ৩৫ টাকা হলেও এর শেয়ারের দর কারসাজির মাধ্যমে গত ১৮ ডিসেম্বর দুই হাজার ৮৮৪ টাকায় নেয়া হয়েছে, যা বিএসইসিকে পাত্তা না দেয়া বলে জানিয়েছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। কারণ বিএসইসি শুধু ব্যাখ্যা নিয়ে কারসাজি চক্রকে ছেড়ে দিয়েছে। এ কারণে কারসাজিকারীরা মনে করছে, কারসজি করলেও শুধু ব্যাখ্যা দিয়েই দায় সাড়া যায়। তাই বিএসইসিকে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে জানান তারা।
তথ্যমতে, চলতি বছরের ২৮ জুলাই থেকে লেনদেন শুরু করে ওটিসি ফেরত কোম্পানি ইউসুফ ফ্লাওয়ার মিলস লিমিটেড। কোম্পানিটি গত ১৩ নভেম্বর শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এতে ওইদিন কোম্পানিটির শেয়ারদর বৃদ্ধি বা কমার ক্ষেত্রে কোনো প্রান্তসীমা বা সার্কিট ব্রেকার না থাকার কারণে মাত্র কয়েক ঘণ্টার লেনদেনে শেয়ারটির দর দুই হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানো হয়। ফলে শেয়ারদর আগের কার্যদিবসে সর্বশেষ লেনদেন হওয়া দামের থেকে সাত হাজার ৫৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। তবে সেদিন লেনদেন শেষে শেয়ারটির দর কমে ৫৯৪ টাকায় এসে দাঁড়ায়, যা অস্বাভাবিক।
এরপর কয়েক দিন শেয়ারটির দর একই জায়গায় থাকলেও ১৭ নভেম্বর থেকে শুরু হয় ফের কারসাজি। এরপর ধীরে ধীরে শেয়ারটির দর বাড়ানো হয়। ফলে প্রথম দফায় শেয়ারটির দর বাড়িয়ে ১ ডিসেম্বর এক হাজার ৬৫৬ টাকা ৭০ পয়সায় নিয়ে কয়েক দিন একই স্থানে রাখা হয়। পরে আবার কারসাজি করে ৬ ডিসেম্বর শেয়ারটি দর এক হাজার ৯৭০ টাকা ৪০ পয়সা নেয়ার পর
থেকে বাড়তে থাকে। ১৩ ডিসেম্বর শেয়ারদর দুই হাজার ৬২২ টাকা ৫০ পয়সায় ওঠানো হয় এবং ১৪ ডিসেম্বর শেয়ারটির দর একই অবস্থানে ছিল। এর পরও বন্ধ হয় না কারসাজি, গত ১৮ ডিসেম্বর শেয়ারের দর ২ হাজার ৮৮৪ টাকায় নেয়া হয়। পরে ৫ জানুয়ারি দর কমে আসে দুই হাজার ৫৯৫ টাকা ৬০ পয়সায়।
কোম্পানির লেনদেন চিত্রে দেখা যায়, লেনদেন শুরুর হওয়ার পর থেকে কোনো শেয়ার লেনদেন হয় না। কিন্তু গত ৮ সেপ্টেম্বর কোম্পানির একটি শেয়ার লেনদেন হয়। পরে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটির আর কোনো শেয়ার লেনদেন হয়নি। এরপর লভ্যাংশ ঘোষণার দিন আবার কোম্পানির ৯টি শেয়ার লেনদেন হয়, যা এ পর্যন্ত কোম্পানির সর্বোচ্চ লেনদেন এবং এ লেনদেনের মাঝে এর দর দুই হাজার টাকায় ওঠানো হয়। পরে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত কোম্পানির কোনো শেয়ার লেনদেন হয়নি। ১৭ নভেম্বর কোম্পানিটির ১০টি শেয়ার লেনদেন হয়। এর পর একই হারে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত লেনদেন হওয়ার পর হঠাৎ ১ ডিসেম্বর কোম্পানিটির ৯০টি শেয়ার লেনদেন হয়। এতে প্রথম ধাপের কারসজিতে শেয়ারদর এক হাজার ৬০০ টাকায় পৌঁছায়। পরে কোম্পানির শেয়ার লেনদেন কমতে থাকলেও দর বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এসএমই প্ল্যাটফর্মে লেনদেন শুরু হওয়ার পর থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানির শেয়ারদর ১১০ গুণের বেশি বৃদ্ধি পায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, প্রথমবার শেয়ারটির দর অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে তলব করা হয় এবং তারা ব্যাখ্যা দেয়। পরে শেয়ারটিকে নজরে রাখা হয়। বর্তমানে শেয়ারটির দর বৃদ্ধির কারণে এর লেনদেন তদন্ত করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে যারা শেয়ার কিনেছে এবং যারা শেয়ার বিক্রি করেছে, তাদের মধ্যে কোনো সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না সেটা দেখা হচ্ছে।
ফলে বিষয়টি কারসাজির কারণে হয়েছে বলে জানিয়ে বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্যাখ্যা নিয়ে ছেড়ে দেয়ায় কারসাজিকারী আরও সুযোগ পেয়েছে। কারণ দীর্ঘদিন ওটিসি মার্কেটে থাকা এবং ব্যবসা তলানিতে থাকা একটি কোম্পানির শেয়ার কী করে প্রায় তিন হাজার টাকায় পৌঁছে? যদি কোম্পানির এনএভির দিকে না তাকিয়ে শুধু কারসাজির মাধ্যমেও দর বাড়ায়, তাতেও এত টাকা শেয়ারদর হওয়া মানে বিএসইসির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা।
তারা বলেন, পুঁজিবাজারে শুরু থেকে কারসাজি চলে এলেও সেইসঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইন সংস্কার ও শাস্তির পরিধি বাড়িয়েছে। কিন্তু সীমাহীন শাস্তির সক্ষমতা নিয়ে বর্তমান সময়ে একটি ‘পচা’ বা ‘দুর্বল’ কোম্পানির শেয়ারদর এ পর্যায়ে পৌঁছানো খুবই দঃখজনক বলে জানান তারা। তাই শুধু ব্যাখ্যা বা নজরে রাখা নয়, কারসাজি বা অনিয়মের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া ছাড়াও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তারা। সেইসঙ্গে শাস্তি যেন আনরিয়েলাইজড বা রিয়েলাইজড মুনাফার থেকেও বেশি হয়, যাতে ভবিষ্যতে আর কারসাজি করতে না পারে, সে ব্যবস্থার কথা বলেন তারা।
অপরদিকে কোম্পানিটি সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য নগদ ১০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। সমাপ্ত অর্থবছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) হয়েছে পাঁচ টাকা ৫৩ পয়সা এবং ২০২২ সালের ৩০ জুন শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ৩৫ টাকা ৫৬ পয়সায়।
বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সর্বশেষ আর্থিক হিসাব অনুযায়ী কোম্পানির এনএভি ৩৫ টাকা। কোম্পানিটি ওটিসি মার্কেট থেকে এসএমই প্ল্যাটফর্মে এসেছে। সেক্ষেত্রে সবারই জানা আছে একটি কোম্পানি কেন ওটিসি মার্কেটে থাকে। কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন বলছে ব্যবসা ভালো অবস্থানে। কিন্তু আসলেই কি কোম্পানিটি ভালো ব্যবসা করেছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা খোঁজ নিয়েছেÑএমন প্রশ্ন তুলে তারা বলেন, কোম্পানি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর নতুন করে যদি ব্যবসা শুরু করেও থাকে, তবু এত ভালো ব্যবসা হবে না যে, এর শেয়ার প্রায় তিন হাজার টাকা হতে পারে।
এদিকে কোম্পানির অনুমোদিত মূলধনই মাত্র দুই কোটি টাকা, আর শেয়ারসংখ্যা ছয় লাখের কিছুটা বেশি। সে হিসাবে কোম্পানি যা মুনাফা করবে, সেটা এ অল্প শেয়ারে ভাগ হওয়ায় বেশি দেখাবে। যদি পরিশোধিত মূলধন বাড়ানো হয়, তবে এনএভি আরও অনেক কমে যাবে বলে জানিয়েছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ৩০ জুন অনুযায়ী কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৬০ লাখ ৭০ হাজার টাকা। কোম্পানির শেয়ারসংখ্যা ছয় লাখ ৬৮ হাজার। এর মধ্যে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের কাছে রয়েছে ৫৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ, সরকারের রয়েছে দশমিক সাত শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ।