আজ মহান বিজয় দিবস। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) হানাদার পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে যৌথবাহিনীর কাছে। বাংলাদেশের এ অর্জন বিপুলভাবে কষ্টার্জিত। অগণিত জানমালের ক্ষতির মধ্য দিয়েই কাক্সিক্ষত বিজয় পেয়েছি আমরা। আজকের এই দিনে তাই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি শহীদদের। এ দেশের অনেক শ্রেষ্ঠ সন্তান চূড়ান্ত বিজয় দেখার আগেই দখলদার বাহিনী ও তার সহযোগীদের প্রতিহিংসামূলক হামলায় শহীদ হন। তাদের কাছে অনেক কিছু প্রাপ্য ছিল জাতির। সে আশাও পূরণ হয়নি। স্মরণ করতে চাই, প্রতিবেশী ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে, যিনি প্রায় এককভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করেছেন বিশ্বমঞ্চে। বাংলাদেশের বিজয় নিশ্চিত করতে গিয়ে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীও হারায় তার বহু সদস্যকে। নিজ দেশের সরকারের সক্রিয় বিরোধিতা সত্ত্বেও সেদিন ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্যও কম করেননি যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি। আজকের দিনটি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে অবদান রাখা দেশি-বিদেশি প্রত্যেককে কৃতজ্ঞতা ভরে শ্রদ্ধা জানানোর দিন।
এই দিনে এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না, বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের আবির্ভাবের পেছনে রাজনৈতিক কারণ তো ছিলই, পাশাপাশি ছিল অর্থনৈতিক বঞ্চনার ক্ষোভ। সেজন্য আমরা লক্ষ করি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু দেশের অর্থনৈতিক মুক্তিসাধনে তার সিংহভাগ প্রচেষ্টা ব্যয় করেন। অবশ্যই সেখানে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ পুনর্গঠনের প্রশ্ন ছিল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তিনি বাংলাদেশকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড বানাতে চান। এমন বক্তব্য থেকে তার এ অভিপ্রায়ই স্পষ্ট হয়, নিছক অর্থনৈতিক মুক্তি তার উদ্দেশ্য ছিল নাÑপ্রত্যাশা ছিল চূড়ান্ত অর্থনৈতিক মুক্তি। জাতির এই উৎসবের দিনে আজ এ বিষয়টির অধিকতর মূল্যায়ন হওয়া দরকার, বিজয় অর্জনের চার দশক পর আজকের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থান কেমন। অর্জিত অগ্রগতিকে কীভাবে বৃহত্তর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে রূপান্তর করা সম্ভব, সে বিষয়েও কার্যকর নীতি-সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন এরই মধ্যে সারা বিশ্বে প্রশংসিত। তার পেছনে এ যাবৎকাল পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত প্রতিটি সরকারের কমবেশি অবদান রয়েছে। এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংকের মতো স্থানীয়-বিদেশি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এবং জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনের মতো উন্নয়ন সহযোগী দেশ। বাংলাদেশের এ অগ্রগতি তাদের সহায়তা ছাড়া অর্জন সম্ভব হতো না। ভবিষ্যতেও তাদের সহায়তা আমাদের প্রয়োজন হবে। এর চেয়ে বড় প্রশ্ন, বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশ অন্য দেশকে ছাড়া চলতে পারবে কি না? তাই এসব দেশ ও সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্কই কাম্য। আরেকটি বিষয়, বাংলাদেশ সুইজারল্যান্ডের মতো জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার মধ্যবর্তী ধাপ হচ্ছে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। এটি বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার। বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান তো বটেই, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের কাম্য বিকাশ ছাড়া ওই লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে। তাই সব ন্যায়সংগত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সহজীকরণে অধিকতর দৃষ্টি দিতে হবে সরকারকে। আরেকটি কথা, মধ্যম আয়ের দেশ থেকে অগ্রসর অর্থনীতির দেশে পরিণত হওয়ার পথে এগোনোর জন্য বাংলাদেশের একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজারের প্রয়োজন। দুঃখজনক হলো, নীতিনির্ধারকদের মাঝে তেমন চিন্তাভাবনা এখনও যথেষ্টভাবে দৃশ্যমান নয়। বরং তাদের কারো কারো মাঝে পুঁজিবাজারকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা রয়েছে বলে মনে হয়। জনগণ এ অবস্থার দ্রুত নিরসনই কামনা করে।