ড.আর এম দেবনাথ: ছাত্রজীবনে যাদের পেছনে থেকে ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, মুর্দাবাদ’ বলে স্লোগান দিয়েছি, তাদের ছেলেমেয়েরা আজ কোথায়? বিরাট সংখ্যক ক্ষেত্রে ওইসব নেতার ছেলেমেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে। যারা এ স্লোগান দেয়নি, তাদেরও অনেকে ওইসব দেশে। অনেকেই ওইসব দেশের নাগরিক; দুই দেশের নাগরিক। এমনকি অনেকে কাছের দেশ মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পের বাসিন্দা। অনেকেই বাস করেন দুবাই প্রভৃতি দেশেও। আমার প্রশ্ন যদি এটি না ঘটত, তাহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা কী হতো? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজি আজকাল অনেক সময়। ইদানীং খোঁজা হয় আরও বেশি। এর অবশ্যই জ্বলন্ত একটি কারণ আছে।
প্রায় সপ্তাহেই ঋণখেলাপিদের ওপর বিভিন্ন কাগজে খবর ছাপা হয়। ঋণ খেলাপের ঘটনা বাড়ছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। এতে ব্যাংকগুলো ডুবতে বসেছে। শ্রেণি বিন্যাসিত বা খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকের পুঁজি ঘাটতি হচ্ছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে ‘প্রভিশন’ রাখতে অনেক ব্যাংক ব্যর্থ হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এ ক্যানসারের জন্য দায়ী ব্যাংক কর্মকর্তারা, ব্যাংকের পরিচালক, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিরা। খবরের ‘তিরটা’ এসবের ওপরই। পাশাপাশি যে আরেকটি ঘটনা ঘটছে, তার খবর মিডিয়ায় সচরাচর থাকে না। আর আমরাও এ নিয়ে তেমন ভাবি না। এই যে ঋণখেলাপিদের অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে এ নিয়ে খবর হচ্ছে না কেন? অবশ্য কেউ কেউ করে। কিন্তু এটি আলোচনার কোনো বিষয় নয়। উদাহরণ দিই। সর্বশেষ একটি খবর দেখলাম এক ‘বিজনেস ডেইলিতে’। খবরটির শিরোনাম: ‘৬৭ কোটি টাকা ঋণ বকেয়া রেখে পলাতক ব্যবসায়ী’। ঘটনাটি চট্টগ্রামের। ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণের টাকা পরিশোধ না করেই সপরিবারে বিদেশে পালিয়েছেন চট্টগ্রামের এক কেমিক্যাল ব্যবসায়ী। আনোয়ারুল হক চৌধুরী নামের এ ব্যবসায়ীর কাছে ব্যাংকটির পাওনা প্রায় ৬৭ কোটি টাকা। খবরে বলা হয়েছে, ব্যাংকটি মামলা করলেও গ্রাহক পলাতক থাকায় মামলার অগ্রগতি শ্লথ। এছাড়া ঋণের বিপরীতে বন্ধক রাখা সম্পত্তির বর্তমান মূল্যও অনেক কম। খবরটিতে তারপর বর্ণনা আছে কীভাবে ওই ব্যবসায়ী ব্যবসায় আসেন, ব্যবসার অবস্থা কেন খারাপ হয় ইত্যাদি। আমি বিস্তারিত বিবরণে আর গেলাম না। শুধু এটুকুই বলার যে, এ ধরনের খবর আজকাল অহরহ ছাপা হচ্ছে যদিও যেসব মিডিয়া খেলাপি ঋণ নিয়ে হইচই বেশি করে, তারা এ ধরনের খবর দেয় না খুব বেশি। দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রামসহ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে একশ্রেণির ব্যবসায়ী ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে অথবা পরিশোধ না করে দেশ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। দুবাই থেকে একজন খেলাপি ঋণগ্রহীতা ঢাকায় মামলা পরিচালনা করছেন, এমন খবরও আছে। অথচ এ ব্যবসায়ী ব্যাংকের কাছে ধরা দিচ্ছেন না। অনেক ব্যবসায়ী মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’-এর অধীনে সেখানে বহাল তবিয়তে ব্যবসা করছেন। অনেকেই কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে অবস্থান করছেন ও দিব্যি আরাম-আয়েশের জীবন যাপন করছেন। শুধু ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের ছেলেমেয়ে নয় দেখা যাচ্ছে, ফৌজদারি মামলার আসামি, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরাও রীতিমতো প্রতাপের সঙ্গে উন্নত দেশে বসবাস করছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিদেরও কেউ কেউ বিদেশে বহাল তবিয়তে আছে। ভাবা যায়! ভাবা যায় না, অথচ ভাবতে হচ্ছে।
আমার প্রশ্ন আগের মতোই। যদি রাজনৈতিক নেতাদের ছেলেমেয়ের মতো ঋণখেলাপি, সাজাপ্রাপ্ত আসামি, দুর্নীতিবাজ এমনকি রোজগারের টাকার মালিকরা এভাবে বিদেশে যেতে না পারত, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ কোন পথে ধাবিত হতো? দেখা যাক, ঘটনাটা কী ঘটছে। কানাডার ঘটনা যে দেশে বাংলাদেশিদের জন্য ‘বেগম নগরী’ তৈরি হয়েছে বলে আমরা জানি। বিশ্বের বিখ্যাত নিউজ ম্যাগাজিন ‘দি ইকোনমিস্ট’ জানুয়ারি মাসের এক তারিখের সংখ্যায় বলছে, ওই দেশে ‘লাইব্রেরি কার্ড’ করাও কঠিন। কিন্তু কোম্পানি করা সহজ ব্যাপার। যে কেউ প্রাইভেট কোম্পানি করতে পারে। লাখ লাখ কোম্পানি ওই দেশে ব্যবসা করছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার মতো কোনো আইন নেই। বড় করপোরেটদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইন আছে। কিন্তু তাদের জন্য নেই। আইন বড়ই জটিল সে দেশে। এ সুযোগে কানাডার বিদেশি ছাত্ররা সমানে বড়িঘর, সহায়-সম্পত্তি কিনছে। অথচ এদের কোনো ঘোষিত উপার্জন, আয় নেই। বোঝাই যায়, এসব সম্পত্তির মালিক তারা নয়, আড়ালে রয়েছে অভিভাবক, অর্থাৎ প্রকৃত মালিকরা। এ কারণে কানাডায় বাড়িঘরের দাম বাড়ছে। এতে অসন্তোষের জš§ হচ্ছে। ইকোনমিস্ট আরও বলছে, কেবল ২০০৯ সালেই কানাডায় ১২ বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। সারা বিশ্বে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ওই বছর ছিল দুই ট্রিলিয়ন (ট্রিলিয়ন সমান লাখ কোটি) ডলার। ভাবা যায়! এটি শুধু কানাডার খবর। ইদানীং যেসব দেশে অর্থ পাচার হচ্ছে বলে খবর বেরোচ্ছে, তার মধ্যে প্রায় সব দেশেই একই অবস্থা। সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থা হচ্ছে দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে, যার নাম দু’দিন পরপর মিডিয়ায় ছাপা হয়। ওইসব দেশে বাংলাদেশের লোকসহ পৃথিবীর সব দেশের লোক নিরাপদে টাকা রাখে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেরও একই অবস্থা। বরং তাদের পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ আমাদের বহুগুণ বেশি। বর্তমান ক্ষমতাসীন ভারত সরকার পূর্বতন সরকারগুলোর বড় সমালোচক ছিল। তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল, পাচারকৃত অর্থ ভারতে এনে প্রত্যেক নাগরিককে কয়েক লাখ রুপি করে দেওয়া হবে। চার বছর বিগতপ্রায়। কোনো অগ্রগতি নেই। ইদানীং যোগ হয়েছে আরেক পাচারকারী, যার নাম নীরব মোদি। প্রায় ১২ হাজার কোটি ভারতীয় রুপি আত্মসাৎ করে তিনি বিদেশে। নীরব মোদি দুই দেশের নাগরিক। তিনি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে বিদেশে আছেন। আরেকজন বিখ্যাত খেলাপি বিজয় মালব্য, যিনি ছিলেন বিমান কোম্পানি, মদের বিশাল কোম্পানি প্রভৃতির মালিক। তাকে ভারতে ফিরিয়ে আনার জন্য দেশটির সরকার আইনি লড়াই করছে। আদালতে মালব্যর আরজিÑতার দেশের জেলখানা নরককুণ্ড, অতএব তাকে সেখানে পাঠানো হবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। আদালত তা শুনছেন।
এসব প্রেক্ষাপটে আমার প্রশ্ন যদি বিভিন্ন দেশের ঋণখেলাপি, প্রভাবশালী লোকেরা, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোররা, এমনকি ‘অনুপার্জিত’ (আন-আর্নড) আয়ের মালিক অর্থাৎ ট্যাক্স ফাঁকিবাজরা বিদেশে এত সহজে না থাকতে পারত; যদি সহজে ওইসব উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে অর্থকড়ি রাখতে না পারত, যদি তাদের ছেলেমেয়েদের ওইসব দেশে নাগরিকত্ব দেওয়াতে না পারত তাহলে কি বাংলাদেশে চুরি-দুর্নীতি, ঘুষ খাওয়া এত সহজে চলত? তাহলে কি এসব অনাচার এত সহজে দেশে চলতে পারত? ধরা যাক, বিদেশে অর্থাৎ পৃথিবীর কোনো দেশেই অর্থ রাখা যায় না, অনুমোদিত পন্থা ছাড়া কোনো দেশেই ব্যাংক হিসাব খোলা যায় না, সম্পদ করা যায় না, বাড়িঘর কেনা যায় না তাহলে কী অবস্থা হতো? ধরা যাক, বাংলাদেশের যেসব ছেলেমেয়ে বিদেশে পড়াশোনা করতে যায়, তারা নির্দিষ্ট ৩-৪-৫ বছরের বেশি সেখানে থাকতে পারবে না বলে বিধান আছে; তাহলে কী হতো? ধরা যাক, দুইশত-পাঁচশত কোটি টাকার রফতানিকারক ‘রফতানির স্বার্থে’ ১৫ শতাংশ ডলার ‘রিটেনশন কোটায়’ বিদেশে রাখতে পারবেন না, তাহলে অবস্থা কী দাঁড়াত? এসব চিন্তা আজকাল মাঝেমধ্যেই মনে আসে। শত হোক, বাংলাদেশে ‘মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন আইন’ জবরদস্তভাবে চালু থাকায় টাকা-পয়সা রাখা খুবই কঠিন। ব্যাংকে রাখা যায় না। সহায়-সম্পদ করা যায় না। কিছু রাখা যায় ব্যবসা করলে স্টকে, ক্যাপিটাল মেশিনারিজের অবমূল্যায়িত দামে। কিন্তু বিপুল পরিমাণ টাকা রাখা খুব কঠিন। লন্ডারিং আইন খুবই কঠোর। এ আইনেই ‘দুদক’ বিচার করে। এ অবস্থায় যদি বিদেশে অর্থ রাখা না যেত, বাঙালির বিদেশে আত্মীয়-স্বজন যদি নাগরিক হতে না পারত; তাহলে কী হতো? মনে হয় কি, দুর্নীতিবাজরা দেশে একটা দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য কায়েম করতে পারত? এসব কেবলই প্রশ্ন। দেশে অনেক সংস্থা আছে, যারা দুর্নীতির অর্থ সম্পর্কে নানা কথা বলে, সমঅধিকারের কথা বলে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে। আমি বুঝি না, এরাও দেশের ক্ষেত্রে যত সোচ্চার বিদেশের ক্ষেত্রে তত সোচ্চার নয় কেন? তারা তো লন্ডনে গিয়ে সভা-সমাবেশ করে বলতে পারেন, তোমাদের দ্বীপপুঞ্জে আমাদের দেশের লোকেদের অবৈধ অর্থসম্পদ আছে। তারা তো কানাডায় গিয়ে বলতে পারেন‘ইকোনমিস্টের’ খবর অনুযায়ী বাংলাদেশি ছাত্রদের বাড়ি-ঘর আছে তোমাদের দেশে। তারা তো সেখানে বলতে পারেন, আমাদের দেশের অনেকেই ‘বেগম নগরীতে’ বাড়ি করেছে। এর জবাব দাও। তোমাদের কী ‘মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন’ আইন নেই? মালয়েশিয়ায় তারা যেতে পারেন। সরকারের সঙ্গে বাহাস করতে পারেন। অথচ স্পষ্টতই তারা তা করেন না। যদি করতেন, তাহলে আমার ধারণা চুরি-দুর্নীতি, লুটপাট অনেকাংশে বন্ধ হতো। শত হোক, দেশে কিংবা বিদেশে যদি ‘অনুপার্জিত’ অর্থ রাখার জায়গা না থাকতÑতাহলে কে না জানে, দুর্নীতি করে টাকা জমানোর প্রবণতাও কমত? আরেকটা পথ খোলা আছে। যে যেভাবেই টাকা কামাক, ‘উত্তরাধিকার ট্যাক্স’ করে তা নিয়ে নেওয়া যেতে পারে। বংশধরদের খাওয়া-পরার টাকাটা শুধু দেওয়া হবে। কেন এ দাবি ওঠে না, তাও জানি না। আমি নিশ্চিত, বিদেশে নিরাপদে অর্থ রাখার জায়গা ও ব্যবস্থা থাকলে, প্রায় উম্মুক্তভাবে সেসব দেশে নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ থাকলে দেশের ভেতর দুর্নীতি কমানো কঠিন। এ বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হলে আমরা একটা পথ খুঁজে পেলেও পেতে পারি।
অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক