ইসমাইল আলী: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে গত বছর শুরু থেকে ঊর্ধ্বমুখী ছিল জ্বালানি তেলের দাম। পাশাপাশি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) দামও ছিল আকাশছোঁয়া। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশে ডলার সংকট। এতে বাধ্য হয়ে তেল ও গ্যাস আমদানি কমানোর মাধ্যমে কৃচ্ছ সাধন নীতির পথে হাঁটে সরকার। জ্বালানি সাশ্রয় করতে গিয়ে কমানো হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন।
অন্যদিকে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাপ কমাতে এরই মধ্যে এক দফা করে বাড়ানো হয়েছে বাল্ক (পাইকারি) ও গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম। আরেক দফা দাম বাড়ানোর কাজ চলছে। গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতে।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, গ্যাস-বিদ্যুতে বিশ্বের কোনো দেশ ভর্তুকি দেয় না। যদিও আন্তর্জাতিক এনার্জি অ্যাসোসিয়েশন (আইইএ) বলছে ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্যমতে, বিশ্বে গ্যাস ও বিদ্যুতে বহু দেশ ভর্তুকি দেয়। সংস্থাটি গত অক্টোবরে এক বিশ্লেষণে দেখিয়েছে, বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রয়েছে ১৩তম অবস্থানে। আর গ্যাসে ভর্তুকি দেয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০ম।
প্যারিসভিত্তিক এ সংস্থার তথ্যমতে, বিদ্যুৎ খাতে বিশ্বে গত বছর অক্টোবর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দিয়েছে ইরান। দেশটি ওই সময়ে ১২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার ভর্তুকি দিয়েছে এ খাতে। পরের অবস্থানে থাকা রাশিয়া ভর্তুকি দেয় সাত দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। আর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে পার্শ^বর্তী দেশ ভারত। দেশটি গত বছর অক্টোবর পর্যন্ত এ খাতে ছয় দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার ভর্তুকি দেয়। চতুর্থ অবস্থানে থাকা সৌদি আরব চার দশমিক ৫৯ বিলিয়ন, পঞ্চম অবস্থানে থাকা চীন তিন দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ও ষষ্ঠ অবস্থানে থাকা মিসর দুই দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার ভর্তুকি দিয়েছে গত বছর অক্টোবর পর্যন্ত।
গত বছর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেয়ার ক্ষেত্রে এরপর রয়েছে যথাক্রমে ইউক্রেন, কুয়েত, মেক্সিকো, ইরাক, আলজেরিয়া ও উজবেকিস্তান। এ ছয় দেশও বিদ্যুৎ খাতে অক্টোবর পর্যন্ত এক বিলিয়ন ডলারের বেশি ভর্তুকি দেয়। আর ১৩তম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিয়েছে দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। শীর্ষ ২০-এ থাকা আর্জেটিনা, কাজাখস্থান, লিবিয়া, অ্যাঙ্গোলা, কাতার, তুর্কেমেনিস্তান ও আজারবাইজান বিদ্যুৎ খাতে এক বিলিয়ন ডলারের কম ভর্তুকি দেয়।
এদিকে আইইএ’র তথ্যমতে, ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত গ্যাসে ভর্তুকি দেয়ায়ও শীর্ষ ইরান। দেশটি ওই সময় পর্যন্ত ১২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার ভর্তুকি দিয়েছেন। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা রাশিয়া ছয় দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ও তৃতীয় অবস্থানে থাকা সংযুক্ত আরব আমিরাত পাঁচ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার ভর্তুকি দিয়েছে। আর সৌদি আরব তিন দশমিক ৮৫ ও উজবেকিস্থান দুই দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার ভর্তুকি দেয়। এছাড়া আলজেরিয়া, তুর্কেমেনিস্তান ও পাকিস্তান এক বিলিয়ন ডলারের বেশি ভর্তুকি দেয় গ্যাস খাতে।
আর্জেটিনা, বাংলাদেশ, ভেনিজুয়েলা, আজারবাইজান, কুয়েত, লিবিয়া, কাজাখস্থান ও ভারত গ্যাসে এক বিলিয়ন ডলারের কম ভর্তুকি দিয়েছে গ্যাস খাতে। এর মধ্যে ১০ম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ ভর্তুকি দিয়েছে শূন্য দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার।
সূত্রমতে, ভর্তুকি কমানোর জন্য গত ডিসেম্বরে বিদ্যুতের গড় বাল্ক মূল্যহার বাড়ানো হয়েছে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং জানুয়ারিতে গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ানো হয়েছে পাঁচ শতাংশ। এতে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য পাঁচ টাকা আট পয়সা থেকে বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ছয় টাকা ২০ পয়সা। আর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম সাত টাকা ১৩ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে সাত টাকা ৪৯ পয়সা। আরও আট শতাংশ বাল্ক ও পাঁচ শতাংশ গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে।
অন্যদিকে ফেব্রুয়ারি থেকে বিদ্যুৎ খাতে সরবরাহকৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বেড়ে হবে ১৪ টাকা, শিল্পে (সব ধরনের) ৩০ টাকা, ক্যাপটিভে ৩০ টাকা এবং বাণিজ্যিকে ৩০ টাকা ৫০ পয়সা। এ হিসাবে আগামী মাস থেকে বাণিজ্যিকে ২৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ, ক্যাপটিভে ৮৭ দশমিক ৫০, বৃহৎ শিল্পে ১৫০ দশমিক ৪২, মাঝারি শিল্পে ১৫৪ দশমিক ৬৭, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে ১৭৮ দশমিক ২৯ এবং বিদ্যুৎ খাতে ১৭৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ দাম বাড়তে যাচ্ছে।
বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহƒত গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটারে ৫ টাকা দুই পয়সা, বৃহৎ শিল্পে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা, মাঝারি শিল্পে ১১ টাকা ৭৮ পয়সা, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে ১০ টাকা ৭৮ পয়সা, ক্যাপটিভে ১৬ টাকা এবং বাণিজ্যিকে ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা। তবে ঘোষিত মূল্যহারে শিল্প খাতে গ্যাসের সব ধরনের সø্যাব তুলে দেয়া হয়।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যবসায়ীদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতেই সরবরাহ বাড়াতে বিদ্যুৎ ও শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। পরিকল্পনা রয়েছে মাসে বাড়তি দুই কার্গো এলএনজি কেনার। এতে বিদ্যুৎ ও শিল্পে চাহিদামতো গ্যাস দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এ প্রসঙ্গে বলেন, কদিন আগে বিদ্যুতের দাম পাঁচ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হলো। অথচ প্রতি ইউনিট ৩০ টাকা দরে গ্যাস কেনার মতো সক্ষমতা কোনো শিল্পের নেই। তিনি এ দাম কমানোর দাবি জানান।