প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে জনজীবনে ভোগান্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক: গত ৬ সেপ্টেম্বরের পর গতকাল দ্বিতীয়বারের মতো দেশের প্রায় অর্ধেক অংশে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটেছে। এ নিয়ে এক মাসের মধ্যে দুবার বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিড আবারও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এদিন গ্রিডে ‘কারিগরি ত্রুটির’ কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের ২৮ জেলায় অন্তত চার থেকে সাত ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল না। তবে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরায় চালু হলেও সব এলাকায় পূর্ণ লোডে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হতে আজ দুপুর ১২টা পর্যন্ত সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

একইসঙ্গে গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনা খতিয়ে দেখতে বিদ্যুৎ বিভাগকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। বিদ্যুৎ বিভাগের একটি এবং তৃতীয় পক্ষের একটি কমিটি বিভ্রাটের কারণ খুঁজে বের করতে কাজ করবে।

এদিকে গতকাল দুপুরে গ্রিড বিপর্যয়ের কারণে যখন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়, তখন গ্রিড বিপর্যয়ের বিষয়টি বুঝে উঠতে পারেননি অনেকেই। কিন্তু পরে অনেক জেলায় একসঙ্গে বিদ্যুৎ না থাকার খবর জানা গেলে গ্রিড বিপর্যয়ের বিষয়টি জানা যায়।

গতকাল বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া জেলাগুলো হলো: ঢাকা, নরসিংদী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাঙ্গামাটি, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও  বান্দরবান।

জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ের সঙ্গে সাইবার হামলার কোনো সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি নাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে বিজিডিই-গভসার্টের নিরাপত্তা ও জাতীয় ডাটা সেন্টার পরিচালক তারেক এম বরকতউল্লাহ জানান, জাতীয় গ্রিড বিপর্যয় ঘটেছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনগুলোতে দুর্বলতার কারণে। এর সঙ্গে সাইবার হামলার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। মাঝেমধ্যেই সরকারের আইটি সেবামূলক খাতগুলোতে সাইবার হামলার ঘটনা ঘটে। আমরা সেসব হামলা প্রতিরোধ করছি।

বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের বিষয়ে দেশে বিদ্যুৎ সঞ্চালনে নিয়োজিত প্রধান সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্রে জানা যায়, জাতীয় গ্রিড মূলত দুটি অঞ্চলে বিভক্ত। গতকাল দুপুর ২টা ৫ মিনিটে জাতীয় গ্রিড ট্রিপ (অকার্যকর) করে। এর ফলে গ্রিডের পূর্বাঞ্চলের আওতাধীন ২৮ জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। দেশে বিতরণকৃত মোট বিদ্যুতের প্রায় ৬৫ ভাগ এ অঞ্চলে ব্যবহƒত হয়। গ্রিডের কোন অংশে (পয়েন্টে) এবং কী ধরনের ত্রুটির কারণে এই বিপর্যয়, তা গতকাল রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত শনাক্ত করতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। বিপর্যয় শুরুর চার ঘণ্টা পর ঢাকা ও সিলেটের কয়েকটি স্থানে গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহ শুরু হয়। গ্রিড ট্রিপ করার কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া কেন্দ্রগুলোর বেশিরভাগই সন্ধ্যা নাগাদ সচল হতে শুরু করে। তবে পূর্ণ লোডে উৎপাদন-সঞ্চালন-বিতরণ শুরু হতে আজ দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে পিজিসিবি এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক প্রকৌশলী জানিয়েছেন।

পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, গ্রিডের কোন অংশে কেন ত্রুটি দেখা দিয়েছে, তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরায় চালু করতে পুরো খাত একসঙ্গে কাজ করছে। কারিগরি ত্রুটির কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা হয়। ত্রুটির কারণ-ধরন জানতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের রিপোর্টের পর পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পিডিবি এবং পিজিসিবির কয়েকজন প্রকৌশলী জানান, নরসিংদীর ঘোড়াশাল পয়েন্টে অথবা সিলেটের একটি পয়েন্টে কারিগরি ত্রুটি প্রথম দেখা দেয় বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। সে কারণেই অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ ও সাব-স্টেশনগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তবে বিস্তারিত তদন্ত ছাড়া এখনই নির্দিষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব হবে না।

ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থা ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান জানান, দুপুর ২টার দিকে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে। শুরুতে বিপর্যয়ের বিষয়টি বুঝতে আমাদেরও কিছুটা সময় লেগেছে। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিস নিজস্ব জেনারেটরে বা অন্য ব্যবস্থায় কার্যক্রম চালু রাখলেও এক সময় সেই ব্যাকআপও অনেকের শেষ হয়ে যায়। পেট্রোল পাম্পগুলোতে ভিড় বাড়ে ডিজেলের জন্য।

বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের প্রভাব পড়ে বঙ্গভবন, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং সচিবালয়সহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতেও। এগুলোতে বিকল্প উপায়ে বিদ্যুৎ সচল রাখা হয়। বিদ্যুৎবিহীন থাকায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হয় হাসপাতালগুলোতে। বিশেষ করে সংকটাপন্ন রোগীদের অবস্থা বেশি খারাপ হয়। শিক্ষা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ সংকটের সঙ্গে সঙ্গে পানিরও তীব্র সংকট দেখা দেয়। কেননা, বিদ্যুৎ না থাকায় অধিকাংশ ভবনে পানির ট্যাংকে পানি তোলা যায়নি।  ফলে সংরক্ষিত পানি শেষ হওয়ার পর বিপাকে পড়ে বহু মানুষ। বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবাও বাধাগ্রস্ত হয়।

পরবর্তীতে গতকাল বিকালে সিলেটের বিয়ানীবাজার এবং গাজীপুরের টঙ্গীতে বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরায় শুরু করে পিজিসিবি ও পিডিবি। প্রথমে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে সহায়ক (অক্সিলারি) বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এরপর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ বিতরণ শুরু হয়। মানিকনগর গ্রিড হয়ে রাজধানীতে বিদ্যুৎ আসে সন্ধ্যা ৬টার দিকে।

পিজিসিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা বদরুদ্দোজা সুমন গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে জানান, বর্তমানে (ওই সময়ে) সারা দেশে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহƒত হচ্ছে। এ সময়ে সারা দেশে সাড়ে ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়। তার মানে অধিকাংশ এলাকায় এখন বিদ্যুৎ আছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা প্রায় ঠিক (রিস্টোর) হয়ে গেছে। তবে সব এলাকায় সরবরাহ স্বাভাবিক হতে আরেকটু সময় লাগবে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা মীর আসলাম গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় জানান, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর, মানিকগঞ্জের পুরো অংশ এবং গাজীপুর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, নারায়ণগঞ্জে  আংশিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক (সিস্টেম রিস্টোর) হয়েছে।

উল্লেখ্য, দেশের স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর। তখন কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা সঞ্চালন কেন্দ্রে বিপর্যয় দেখা দিলে ভারতের সঙ্গে সঞ্চালন লাইন বন্ধ হয়ে যায়। একই সময় দেশের উৎপাদনে থাকা সব বিদ্যুৎকেন্দ্র একযোগে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সারা দেশে বিদ্যুৎ বিপর্যয় (ব্ল্যাক আউট) দেখা দেয়। তখন কোনো এলাকায় ১৫-১৬ ঘণ্টায় বিদ্যুৎ এলেও পুরো গ্রিডে পূর্ণ লোডে স্বাভাবিক সঞ্চালন-বিতরণ নিশ্চিত করতে ৩৭-৩৮ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। এরপর ২০১৭ সালের ১ ও ৩ মে তিন দফায় বিপর্যয় ঘটে। গতকালের আগে সর্বশেষ গত ৬ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টা ৪ মিনিটে গ্রিডের পশ্চিমাঞ্চলে ট্রিপ করে। তখন অনেক এলাকায় এক ঘণ্টায় বিদ্যুৎ সরবরাহ পুনরায় চালু হলেও সঞ্চালন-বিতরণ পূর্ণ লোডে স্বাভাবিক হতে প্রায় আট ঘণ্টা সময় লাগে।