পূর্ব প্রকাশের পর……
ড. শাহ এমরান: মার্চেন্ট মধ্যস্বত্বভোগী: যেসব মধ্যস্বত্বভোগী প্রান্তিক মুনাফায় পুনঃবিক্রির উদ্দেশ্যে পণ্যসামগ্রী কেনেন, তাদের মার্চেন্ট মধ্যস্বত্বভোগী বলে। এ ধরনের মধ্যস্বত্বভোগীরা পণ্য কিনে নিজের মালিকানায় নেন এবং পরে নিজ পণ্য হিসেবে ক্রেতার কাছে বিক্রি করেন। এদের দুই ভাগ করা যায় ১. পাইকারি বিক্রেতা, ২. খুচরা বিক্রেতা।
পরোক্ষ বিক্রি : পরোক্ষ বিক্রি দুই ভাগে সম্পন্ন হয়। যথা পাইকারি ক্রয়-বিক্রয় ও খুচরা ক্রয়-বিক্রয়।
পাইকারি ক্রয়-বিক্রয়: যে বিপণন প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যবসায়ী উৎপাদকের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে পণ্য কেনেন কিন্তু খুচরা ব্যবসায়ী ও শৈল্পিক ভোক্তার কাছে অল্প পরিমাণে পণ্য সরাসরি বিক্রি করেন, সে বিপণন প্রক্রিয়াকে পাইকারি ক্রয়-বিক্রয় বলে। পাইকারি বিক্রেতা কদাচিত সরাসরি ভোক্তার কাছে পণ্য বিক্রি করে থাকেন। যে ব্যক্তি পাইকারি ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাকে পাইকারি ব্যবসায়ী বা আড়তদার বা মজুতদার বলে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা উৎপাদক ও খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেন।
পাইকারি ব্যবসায়ীদের প্রকারভেদ
উৎপাদক পাইকারি ব্যবসায়ী-এরা নিজেরাই পণ্য উৎপাদন করেন ও তা পাইকারি দরে বিক্রি করেন। একইসঙ্গে তারা অন্য উৎপাদকের পণ্যও কেনেন এবং নিজ পণ্যের সঙ্গে ওইসব পণ্যও বিক্রি করেন।
তারা আলাদাভাবে পাইকার বা আড়তদার নিযুক্ত
করতে হয় না বলে এবং কম দামে কিন্তু বেশি লাভে পণ্য কেনা-বেচা করতে পারেন।
খুচরা পাইকার/আড়তদার: এরা উৎপাদকের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে পণ্য কেনেন এবং তা সাধারণ পাইকার ও ভোক্তা উভয়ের কাছে বিক্রি করেন।
বিশুদ্ধ পাইকার/আড়তদার: এই শ্রেণির আড়তদাররা শুধু আড়তদারী ব্যবসায় জড়িত থাকেন। তারা পণ্য উৎপাদন করেন না। তারা উৎপাদকের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে পণ্য কেনেন; কিন্তু অল্প পরিমাণে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। পণ্য কেনা-বেচায় তথা সরবরাহে তারা নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা ব্যবহার করেন। এরা নিয়মিত নির্ধারিত মাসোহারা অথবা নির্দিষ্ট কমিশনে কাজ করে থাকেন। এরা উপজেলা, জেলা বা বিভাগভিত্তিক আড়তদার হিসেবে কাজ করতে পারেন।
পাইকারদের কাজ: পণ্যের সংগ্রহ (কালেকশন অব গুডস) বিভিন্ন উৎপাদকের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য কিনে তা একত্র করেন এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে তা পুনঃবিক্রি করেন। বিতরণ: ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে খুচরা ব্যবসায়ীর মাধ্যমে বিতরণের কাজটি করেন। মজুতকরণ: উৎপাদক ও খুচরা ব্যবসায়ী উভয়ের সুবিধার জন্য তিনি পণ্য মজুত করেন। পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহারের মধ্যে সময়ের ব্যবধানকে সমন্বয় করার জন্য এটা প্রয়োজন, আবার খুচরা ব্যবসায়ীদের চাহিদা মেটাতে এটা দরকার। অর্থায়ন: আড়তদার সাধারণত উৎপাদকের কাছে অগ্রিম টাকা দিয়ে পণ্য কিনে বাকিতে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। এভাবে তিনি উভয় পক্ষকে আর্থিক সহায়তা করেন। শ্রেণিবিভাজন ও মোড়কীকরণ: আড়তদার পণ্যের গুণ ও মান এবং ভোক্তার চাহিদা অনুযায়ী পণ্যকে ছোট, মাঝারি বা বড় এ ধরনের বিভিন্ন মোড়কে মোড়কীকরণ করেন এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। যেমন: ডিম বা আম আকার আয়তন অনুযায়ী সাজিয়ে বিক্রির জন্য প্যাকেট করা হয়। পরিবহন: আড়তদার সাধারণত বড় দাগে পণ্য কেনেন এবং ছোট ছোট দাগে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। আর ছোট ব্যবসায়ীরা যেহেতু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পাইকার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বসবাস করেন, সে কারণে তিনি নিজস্ব বা ভাড়া করা গাড়িতে করে ওইসব পণ্য ছোট ব্যবসায়ীদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ফলে ছোট ব্যবসায়ীদের পণ্য নেওয়া আনার ঝামেলা পোহাতে হয় না। ঝুঁকি নেওয়া: বিশাল পরিমাণে পণ্য কেনা ও মজুত করার মাধ্যমে বড় ধরনের আর্থিক ঝুঁকি নিয়ে থাকেন। কেননা পণ্যের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যেতে পারে, পণ্যের দাম কমে যেতে পারে, খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাওনা আদায়ে ঝামেলা হতে পারে। এছাড়া চুরি, ডাকাতি ও অগ্নিকাণ্ডে বিরাট ক্ষতি হতে পারে। বাজারসংক্রান্ত তথ্যাদির যোগাযোগ: উৎপাদক ও খুচর ব্যবসায়ী উভয়ের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহে ভূমিকা পালন করেন। বাজার জরিপের মাধ্যমে তিনি ভোক্তার অগ্রাধিকার, রুচিবোধ, পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদি তথ্য উৎপাদকের কাছে পৌঁছে দেন। অন্যদিকে দামের হ্রাস-বৃদ্ধি, নতুন পণ্য বাজারে আসা ইত্যাদি তথ্য খুচরা ব্যবসায়ীর কাছে পৌঁছে দেন।
পাইকারি বাণিজ্যের সুবিধা
এ ধরনের বাণিজ্যে উৎপাদক কিছু সুবিধা পেয়ে থাকেন। এগুলো হলো অগ্রিম ক্রয়াদেশ পাওয়ার কারণে বিপুল পরিমাণে উৎপাদন করতে পারেন। বাজারসংক্রান্ত তথ্য পেয়ে থাকেন। বিজ্ঞাপনের মতো বিপণনের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হয়ে যায়। বড় দাগে কেনা ও মজুত করার মাধ্যমে ঝুঁকি হ্রাস পায়। অগ্রিম অর্থায়নের ফলে আর্থিক সুবিধা পাওয়া যায়। চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থায় সমন্বয়ের মাধ্যমে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে।
পাইকারি বাণিজ্যে খুচরা বিক্রেতারা যেসব সুবিধা পেয়ে থাকেন। যেমন খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রির জন্য বিভিন্ন উৎপাদকের পণ্য জমা করতে পারেন, অল্প দাগে ভোক্তার কাছে পণ্য বিক্রি কাতে পারেন, যা উৎপাদকের পক্ষে সম্ভব নয়। ধারে বিক্রির মাধ্যমে খুচরা বিক্রেতাকে আর্থিক সহায়তা করতে পারেন। খুচরা বিক্রেতাকে বড় দাগে মজুত করার ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখতে পারেন। পণ্যের দামের ওঠানামা ও নতুন পণ্যের বাজারজাত করার খবর খুচরা বিক্রেতাকে দিয়ে থাকেন। খুচরা বিক্রেতাকে বেশি পরিমাণে কেনার জন্য বাট্টা দিয়ে থাকেন। পণ্যের বিজ্ঞাপনের কাজটি এর মাধ্যমে হয়ে যায় বলে খুচরা বিক্রেতার বিক্রি বাড়ে। খুচরা বিক্রেতার দোকান পর্যন্ত পণ্য পৌঁছে দেন পাইকারি বিক্রেতা।
পাইকারি বাণিজ্যে ভোক্তাসমাজের সুবিধা হলো এতে খুচরা বিক্রেতা ভোক্তাকে তার রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করে থাকেন। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে
পণ্যের সর্বশেষ তথ্য জানান। পর্যাপ্ত পণ্য সরবরাহ
করে তিনি দাম স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করেন। তিনি যথেষ্ট পরিমাণে পণ্য মজুত করে রাখেন বলে বাজারে পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয় না।
পাইকারি বাণিজ্যের অসুবিধা
মুনাফার পরিমাণ বাড়িয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন বিক্রেতা। কালোবাজারি বা মজুতদারির মাধ্যমে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন। বেশি লাভের আশায় কখনও কখনও নকল পণ্য সরবরাহ করেন। মুনাফার তুলনায় উত্তম সেবা পাওয়া যায় না।
খুচরা বাণিজ্য: খুচরা বাণিজ্য বা কেনা-বেচা হলো বিতরণের সর্বশেষ ধাপ এবং এই ধাপে খুচরা ব্যবসায়ী পণ্য সরাসরি ভোক্তার কাছে বিক্রি করনে। যে ব্যবসায়ী খুচরা কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িত, তাকে খুচরা ব্যবসায়ী/ বিক্রেতা বলে। উৎপাদক বা পাইকারি ব্যবসায়ী আর ভোক্তার মধ্যে যোগাযোগের কাজটি খুচরা ব্যবসায়ী করে থাকেন।
খুচরা বাণিজ্যের কাজ
পণ্য সংগ্রহ: ভোক্তার চাহিদা মেটাতে খুচরা ব্যবসায়ী বিভিন্ন ধরনের পণ্য সংগ্রহ করেন। পরিবহন: খুচরা ব্যবসায়ী উৎপাদক বা পাইকারি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পণ্য তার দোকানে নিয়ে আসেন। ভোক্তারা সহজেই কাছাকাছি দোকান থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে পারেন। অনেক সময় খুচরা বিক্রেতা বিনা খরচে পণ্য ভোক্তার বাসস্থান বা কর্মস্থান পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে থাকেন। মজুতকরণ: গ্রাহকের চাহিদামতো পণ্য মজুত রাখেন, আবার নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ বজায় রাখতে পণ্য মজুত রাখেন।
ধারে বিক্রি: নিয়মিত খরিদ্দারদের ধারে পণ্যসামগ্রী দিয়ে থাকেন। ঝুঁকি নেওয়া: ভোক্তা সময়মতো ধারদেনা শোধ না করায় ঝুঁকির পাশাপাশি চুরি-ডাকাতি, অগ্নিকাণ্ড, পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়া, পণ্যের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া এবং পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ার মতো ঝুঁকি নিতে হয়। বাজার গবেষণা: ভোক্তার সরাসরি সংস্পর্শে থাকেন বলে ভোক্তার রুচি, মেজাজ-মর্জি, চাহিদা প্রভৃতি বুঝতে ও বিচার করতে পারেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে উৎপাদককে তথ্য সরবরাহ করতে পারেন।
খুচরা বাণিজ্যের সুবিধা
এ ধরনের বাণিজ্যে উৎপাদক ও পাইকারি বিক্রেতা কিছু সুবিধা পেয়ে থাকেন। উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যকার শেষ সেতুবন্ধন হলো খুচরা ব্যবসায়ীরা এবং তারা পণ্য বিতরণে সহায়তা করেন। এরা বহু ভোক্তার কাছে অল্প অল্প করে পণ্য বিক্রি করেন, যা উৎপাদক ও পাইকারের পক্ষে সম্ভব নয়। খুচরা ব্যবসায়ীর সহায়তা ছাড়া নতুন পণ্য বাজারজাত করা অসম্ভব। পাইকার হয়ে উৎপাদক পর্যন্ত তারা ক্রেতার রুচি, অগ্রাধিকার, মূল্যবোধ, চাহিদা ইত্যাদি তথ্য সরবরাহ করে থাকেন। অনেক সময় তারা পাইকারকে অগ্রিম টাকা দিয়ে পণ্য আনার ব্যবস্থা করেন; ফলে পাইকারের আর্থিক সহায়তা হয়। খুচরা বাণিজ্যে ভোক্তার প্রাপ্ত সুবিধাগুলো হলো খরিদ্দারের চাহিদা মোতাবেক সম্ভাব্য কম পরিমাণে পণ্য বিক্রি করা হয়। অনেক ধরনের পণ্য রাখেন বলে ভোক্তা পছন্দমতো পণ্য কিনতে পারেন। ভোক্তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রক্ষার মাধ্যমে পণ্য সম্পর্কে তাদের বক্তব্য বা অভিযোগ শুনে তার জবাব দিতে সচেষ্ট হন। পণ্যের গুণাগুণ সম্পর্কে এসব খাঁটি তথ্য উৎপাদকের কাছে পৌঁছে দেন, যেন ভবিষ্যতে পণ্যটি ত্রুটিমুক্ত হয়। পণ্যের উপযোগিতা, ব্যবহার ও সংরক্ষণ বিষয়ে ভোক্তাকে উপদেশ দিয়ে থাকেন। খরিদ্দারকে নিয়মিত বিনা খরচে পণ্য পৌঁছে দেন, আবার বিক্রয়োত্তর সেবাও দিয়ে থাকেন। আর্থিক সংকটকালে ধারে পণ্য দিয়ে ভোক্তাকে সহায়তা করেন। বিক্রীত পণ্যের ওপর বাট্টা দিয়ে থাকেন। তাজা ও সর্বশেষ পণ্যটি ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেন। খুচরা দোকানগুলো আবাসিক এলাকার কাছাকাছি হওয়ায় ভোক্তার দৈনন্দিন চাহিদা সহজে মেটাতে পারেন। জরুরি অবস্থায় দিন-রাত দোকান খোলা রাখেন বলে ভোক্তারা উপকৃত হন।
খুচরা বিক্রেতার প্রকারভেদ
অস্থায়ী নিত্যপণ্য বিক্রয়কারী খুচরা দোকানি: রিকশাচালক, হকার, ফেরিওয়ালা, ভ্যানগাড়িওয়ালা।
স্থায়ী দোকানে ছোট দাগের পণ্য বিক্রেতা: ক) রাস্তায় স্টল দিয়ে পণ্য বিক্রয়কারী দোকানদার; খ) ব্যবহার্য পণ্য বিক্রয়কারী দোকানদার; গ) সাধারণ দোকানদার ও ঘ) বিশেষায়িত পণ্য বিক্রয়কারী দোকানদার।
স্থায়ী দোকানে বড় দাগে পণ্য বিক্রেতা: ক. ডিপার্টমেন্ট স্টোর; খ. বহুবিধ দোকান; গ. ডাকযোগে পণ্য প্রেরণ ব্যবসা; ঘ. সুপার মার্কেট; ঙ. সমবায় দোকান; চ. ভাড়ায় কেনা দোকান।
অস্থায়ী বা ভ্রাম্যমাণ খুচরা বিক্রেতা: এ ধরনের খুচরা বিক্রেতার বসার কোনো সুনির্দিষ্ট জায়গা বা দোকান নেই। তারা মাথায় করে বা ভ্যানগাড়িতে করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে ঘুরে পণ্য বিক্রি করে। এরা অতিসহজে বিক্রি করা যায়, এমন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করেন। যেমন শাকসবজি, তরিতরকারি, ফলমুল, চুড়ি, লেইস ফিতা, চানাচুর, ঝালমুড়ি প্রভৃতি। (চলবে….)
অধ্যাপক, ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়