নিজস্ব প্রতিবেদক:বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালক, প্রধান প্রকৌশলী, মহাব্যবস্থাপকসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মিসর থেকে বোয়িংয়ের দুই উড়োজাহাজ লিজ নেয়া এবং রি-ডেলিভারি পর্যন্ত বিমানের এক হাজার ১৬১ কোটি টাকার ক্ষতি সাধন করার অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়। উপপরিচালক জেসমিন আক্তার বাদী হয়ে গতকাল দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে (ঢাকা-১) মামলাটি দায়ের করেন। দুদক সচিব মাহবুব হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এজাহারে অভিযোগ, ২০১৪ সালে পাঁচ বছরের চুক্তিতে ইজিপ্ট এয়ার থেকে বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর উড়োজাহাজ দুটি লিজ নিয়েছিল বিমান। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফ্লাইট পরিচালনার পর একটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। উড়োজাহাজটি সচল রাখতে ইজিপ্ট এয়ার থেকেই ভাড়ায় আনা হয় আরেকটি ইঞ্জিন। দেড় বছরের মাথায় নষ্ট হয় বাকি ইঞ্জিনটিও। উড়োজাহাজটি সচল রাখতে ইজিপ্ট এয়ার থেকে আবারও ভাড়ায় আনা হয় আরেকটি ইঞ্জিন। পরে ভাড়ায় আনা ইঞ্জিনও নষ্ট হয়ে যায়। সেই ইঞ্জিন মেরামত করতে যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়। তবে কোনো সময় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। সে কারণে ইজিপ্ট এয়ার এবং মেরামতকারী কোম্পানি উভয়কেই অর্থ দিতে হয়েছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তদন্তের পর আইনগত ব্যবস্থা নিতে বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানোর সুপারিশ করে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। দুদকে আসার পর অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপর দুই সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়।
মামলার আসামিরা হলেনÑবিমানের সাবেক পরিচালক (ফ্লাইট অপারেশন) ক্যাপ্টেন ইনরাত আহমেদ, সাবেক ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার শফিকুল আলম সিদ্দিক (এসএ সিদ্দিক), মহাব্যবস্থাপক (মুদ্রণ ও প্রকাশনা) আবদুর রহমান ফারুকী, সার্ভিসেস অ্যান্ড অডিটের সাবেক প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার শহীদ উদ্দিন মোহাম্মদ হানিফ, সাবেক প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার (এমসিসিঅ্যান্ডএলএম) দেবেশ চৌধুরী, সিভিল এভিয়েশন অথরিটির (ক্যাব) কনসালটেন্ট গোলাম সারওয়ার ও ক্যাবের প্রকৌশলী কর্মকর্তা মো. সাদেকুল ইসলাম ভূঞা, বিমানের ডিজিএম কামাল উদ্দিন আহমেদ, প্রধান প্রকৌশলী এআরএম কায়সার জামান (প্রিন্সিপাল সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার (স্ট্রাকচার) শরীফ রুহুল কুদ্দুস, ক্যাপ্টেন মো. নজরুল ইসলাম শামিম, উপ মহাব্যবস্থাপক (এওসি, এসিপি) জিয়া আহমেদ, চিফ পার্সার (অবসরপ্রাপ্ত) কাজী মোসাদ্দেক আলী, ফ্লাইটপাসার মো. শহিদুল্লাহ কায়সার ডিউক এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস লিমিটেডের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার করপোরেট (প্ল্যানিং) মো. আজাদ রহমান।
অন্য আসামিরা হলেনÑবিমানের সাবেক ব্যবস্থাপক মো. আব্দুল কাদির, উপপ্রধান প্রকৌশলী (অবসরপ্রাপ্ত) মো. শাহজাহান, ইঞ্জিনিয়ার অফিসার (অব.) জাহিদ হোসেন, সহকারী ব্যবস্থাপক পরিকল্পনা ফজলুল হক বসুনিয়া, ব্যবস্থাপক এসিপি আতাউর রহমান, চিফ পার্সার (অবসরপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ সাজ্জাদ উল হক (শাহিন), ফ্লাইট পার্সার শাহনাজ বেগম ঝরনা এবং চিফ ইঞ্জিনিয়ার (ইঞ্জিনিয়ারং সার্ভিসেস) গাজী মাহমুদ ইকবাল।
অভিযোগে বলা হয়, মামলার আসামিরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে আগে নিজেরা
লাভবান হন, অপরকে লাভবান করার অসৎ উদ্দেশ্যে ইজিপ্ট এয়ার থেকে দুটি প্লেন লিজ নিয়ে ও পরে রি-ডেলিভারি পর্যন্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস লিমিটেডের এক হাজার ১৬১ কোটি টাকার ক্ষতি ও অর্থ আত্মসাৎ করেন। তারা দণ্ডবিধির ১০৯/৪০৯/৪২০ ধারায় এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। মামলার তদন্তকালে অভিযোগের সঙ্গে অন্য কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তা আমলে আনা হবে।
এজাহারে বলা হয়, উড়োজাহাজ দুটি পাঁচ বছরের জন্য লিজ নেয়া হলেও লিজ নেয়ার পর মাত্র ১১ মাস পরিচালনা করার পর ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সয়ে উড়োজাহাজ দুটির ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়। ইউনাইটেড এয়ারলাইনসে নিয়ে মেরামত করতে না পারায় (গঝঘ ৩২৬৩)ঝ২-অঐখ উড়োজাহাজটি ২০১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে গ্রাউন্ডেড হয়। উড়োজাহাজগুলো সচল রাখার জন্য ইজিপ্ট এয়ার থেকে আবার আরও চারটি ইঞ্জিন লিজ নেয়া হয়। সেগুলোও নষ্ট হয়ে যায়। এয়ারক্রাফটগুলো রি-ডেলিভারির জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলে মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে গাজী মাহমুদ ইকবাল ইজিপ্টএয়ার থেকে লিজ নেয়া উড়োজাহাজগুলোর রি-ডেলিভারির জন্য ঠিকাদার নিয়োগের সময় টেন্ডার ডকুমেন্টসের শর্তভঙ্গ করে অনৈতিকভাবে নন-রেসপন্সিভকে ঠরবঃহধস অরৎষরহবং ঊহমরহববৎরহম খরসরঃবফ ঈড়সঢ়ধহু (ঠঅঊঈঙ) রেসপনসিভ করেন। দরপত্রের শর্ত ব্যত্যয় ঘটিয়ে ওই নন-রেসপনসিভ ঠিকাদারের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি কিনে বিমানের ৩৪ কোটি ৮২ লাখ ৯০ হাজার ১৩৮ টাকা ক্ষতিসাধন করা হয়। যদি কমার্শিয়ালি সেটেলমেন্টের মাধ্যমে উড়োজাহাজগুলো ফেরত দেয়া যেত, তাহলে ক্ষয়-ক্ষতি এড়ানো যেত। কিন্তু অসৎ উদ্দেশ্য এবং দুর্বল চুক্তির কারণে ফেরত দিতে না পারায় লিজের সময় সম্পন্ন করে এয়ারক্রাফটগুলো ফেরত দেয়া হয়। গ্রাউন্ডেড অবস্থায়ও সম্পূর্ণ ভাড়া দিতে হয়। মিসর থেকে নেয়া একটি এয়ারক্রাফট ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর ও দ্বিতীয় এয়ারক্রাফটটি একই বছরের ৯ ডিসেম্বর তারিখে ফেরত দেয়া হয়।
মিসর থেকে বোয়িংয়ের দুটি উড়োজাহাজ লিজ-সংক্রান্ত এক হাজার ১০০ কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ অনুসন্ধানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের প্রধান কার্যালয়ে গত বছরের ১ জুন অভিযান পরিচালনা করেছিল দুদক। উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়েছিল। মাঝে বদলিজনিত কারণে উপপরিচালক আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে দুদক টিম পুনর্গঠন করা হয়।