প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

বিশ্বমোড়ল হতে কতটা প্রস্তুত চীন?

ড. মো. রফিকুল ইসলাম: সাম্প্রতিক সময়ে চীনের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক অগ্রগতি, বিশাল সামরিক শক্তি এবং মহাকাশ গবেষণায় অভূতপূর্ব অগ্রগতি আগামী দিনে বর্তমানের বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে চীনকে বিশ্বনেতৃত্বের মোড়ল করবে বলে গবেষক, তাত্ত্বিক, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিক ও সামরিক শক্তি বিশ্লেষক এমনকি সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হচ্ছে। তার ওপর প্রতীয়মান হচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং চীন-রাশিয়া ও চীন-ইরান সম্পর্ক। সাম্প্রতিক সময়ে জিসিসি দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্টের বৈঠক, সৌদি যুবরাজের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের শীতল সম্পর্ক, সস্তা পণ্য দিয়ে বিশ্ববাজার দখল প্রভৃতি ঘটনাপ্রবাহ চীনকে বিশ্বমোড়ল হওয়ার পথে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে বলে অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। এই বিশ্বাসকে আরও গতি দিয়েছে নিকট অতীতে যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো শাসকের আবির্ভাব, যার কাছে বিশ্ব নয়, যুক্তরাষ্ট্র প্রথম নীতি অগ্রাধিকার পেয়েছে। যারা বিশ্বাস করেন চীন বিশ্বনেতৃত্বের আসনে সমাসীন হওয়ার দ্বারপ্রান্তে, তারা এই আশা করছেন যে, আবারও যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো অতি জাতীয়তাবাদী শাসক ক্ষমতায় আসবেন এবং যুক্তরাষ্ট্র তার চিরচেনা বিশ্বমোড়লগিরি বাদ দিয়ে নিজ দেশ নিয়ে থাকবেন। বিষয়টি এত সহজ নয়। এখন দেখা যাক, বিশ্বমোড়ল হওয়ার কোন পর্যায়ে চীন রয়েছে এবং তাদের সামনে কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

এক. ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা: বিশ্বমোড়লকে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক ক্ষেত্রে ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। বৈশ্বিক ভিন্নমতের লালন বা দমন নিয়ে চীনের কোনো মাথাব্যথা দৃশ্যমান নয়, চীন এটাকে সবসময় অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বিবেচনা করে। চীন তার নিজ দেশের ভিন্নমত দমনে তৎপর এবং অতি কঠোর। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দমনের বিষয়ে চীনের তীব্র সমালোচনা রয়েছে। ভিন্নমত দমনের ক্ষেত্রে চীন আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে সাম্প্রতিক সময়ে অতি ধনাঢ্য কিছু ব্যক্তিকে গুম করার ক্ষেত্রে (যার অনেকেই আবার কিছুদিন পর ফিরে এসেছে), যার সর্বশেষ উধারণ বাও ফ্যান। তিনি চীনের সুপরিচিত বিলিওনেয়ার ব্যাংকারদের একজন। তার কোম্পানি গত ১৬ ফেব্রুয়ারি এক ঘোষণায় নিশ্চিত করেছে, চায়না রেনেসাঁ হোল্ডিংসের প্রধান নির্বাহী বাও ফ্যানের সঙ্গে তারা গত কয়েক দিন যোগাযোগ করতে পারছেন না। এর আগে চীনের শেয়ারবাজার নিয়ে মন্তব্য করার পর তিন মাস নিখোঁজ ছিলেন আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মাও। যদিও চীন কখনও এ ধরনের গুমের কথা স্বীকার করে না। এভাবে নিজদেশের অভ্যন্তরে দমনপীড়ন করে এবং বৈশ্বিক ভিন্নমতকে লালন না করে বিশ্বনেতৃত্বের আসনে সমাসীন হওয়া আকাশ-কুসুম কল্পনামাত্র।

দুই. নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়ানো: বিশ্বমোড়লের অন্যতম নৈতিক দায়িত্ব নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়ানো এবং সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করা। এক্ষেত্রে চীনের দৃশ্যমান কোনো অবস্থান নেই। ফিলিস্তিন ইস্যু, রোহিঙ্গা সমস্যা, ইয়েমেন যুদ্ধ, লেবাননের সংকট বা বিশ্বের অন্য কোথাও নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়াতে চীনের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।

তিন. গণতন্ত্রের বিকাশসাধন: এখন পর্যন্ত বিশ্বে সরকার নির্বাচন এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে যেসব পদ্ধতি বিদ্যমান তার মধ্যে গণতন্ত্র সর্বোৎকৃষ্ট (যদিও গণতন্ত্র সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়)। চীনের শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। তাছাড়া বিশ্বের যেসব দেশে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই, সেসব দেশের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। যেমনÑউত্তর কোরিয়া, মিয়ানমার প্রভৃতি। আবার ইরান ও রাশিয়ার মতো কর্তৃত্বপরায়ণ দেশের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে যেসব দেশ কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠছে এবং নিজ দেশের জনগণের ওপর দমনপীড়ন চালাচ্ছে, তাদের নিয়ে চীনের কোনো মাথাব্যথা নেই। এভাবে সবকিছু এড়িয়ে গিয়ে শুধু অর্থনৈতিক অগ্রগতি দিয়ে বিশ্বমোড়ল হওয়া যাবে না।

চার. সামরিক শক্তি: সামরিক দিক দিয়ে চীনের রয়েছে বিশাল এক বাহিনী এবং তাদের সামরিক বাজেটের পরিমাণ প্রথম দিকে। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রেও তারা সজ্জিত। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য দেশগুলোর সমরশক্তির তুলনায় যথেষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সমান সামরিক শক্তি অর্জন করে বিশ্বকে টেক্কা দিতে হলে চীনকে আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।

পাঁচ. ব্রেইন ড্রেইন: বিশ্বনেতৃত্বের আসন গ্রহণ এবং তা ধরে রাখার জন্য মেধার লালন এবং বুদ্ধিজীবীদের একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। অনেক পুরোনো কাল থেকে পাশ্চাত্য ও যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্র, শিক্ষক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের তাদের দেশে পুনর্বাসন করেছে। পুনর্বাসন না করতে পারলেও বিভিন্ন মেধাবৃত্তির মাধ্যমে নিজ দেশে মেধাবীদের শিক্ষাদান করেছে। এর মাধ্যমে তারা তাদের সংস্কৃতি, বাকস্বাধীনতা, কাজের নিশ্চয়তা, শিক্ষার মান, যোগ্যতার মূল্যায়ন প্রভৃতি বিষয় বিশ্বে প্রচার করে থাকে (স্নায়ুযুদ্ধকালে যা বহুল ব্যবহƒত হয়েছে), যা মতাদর্শগত দিক দিয়ে পাশ্চাত্য ও যুক্তরাষ্ট্রকে এগিয়ে রেখেছে। এক্ষেত্রে চীন অনেক পিছিয়ে আছে। ইদানীং কালে চীন কিছু বৃত্তি দিয়ে মেধাবীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিচ্ছে, কিন্তু তা যৎসামান্য মাত্র।

ছয়. শরণার্থীদের আশ্রয়: যুদ্ধবিগ্রহের কারণে মাধ্যপ্রাচ্যে চলছে অস্থিরতা, সিরিয়া যুদ্ধে লাখো অধিবাসী বাস্তুচ্যুত হয়েছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর যে জাতিগত নিধন হয়েছে এবং তার ফলে যে লাখো শরণার্থী সৃষ্টি হয়েছে, তার একজনেরও আশ্রয় চীন দিতে পারেনি। ইয়েমেন যুদ্ধ, লিবিয়া ইস্যু, লেবাননের আর্থিক সংকট প্রভৃতি নিয়ে চীনের কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যায় না। আগামীতে যে দেশ বিশ্বনেতৃত্বের আসনে বসতে চায়, এটা তার জন্য কোনো ভাল লক্ষণ নয়।

সাত. বিশ্ব সংগঠনের ভূমিকা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে যেসব সংগঠন যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যকে বিশ্বমোড়ল হতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে, তার অন্যতম হলো বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ। তারা এখনও তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। সহজ করে বললে, বিশ্বপুঁজিবাদের বিকাশ এবং বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রায়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে কাজ করে চলেছে। এসব সংগঠনের কোনো বিকল্প আজও বিশ্বে নেই এবং চীন নতুন করে কোনো সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার মতো অবস্থা ও চাহিদা বিশ্বে সৃষ্টি করতে পারেনি। যদিও নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক নামে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গঠন করেছে, কিন্তু তা কোনোক্রমেই বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে বলে বিশ্বাস করা কঠিন। এরকম একটা অবস্থায় দাঁড়িয়ে বিশ্বমোড়ল হতে চীনকে শত বছর লড়াই করতে হবে। সাত. ভূ-অবস্থান: বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান তাদের বিশ্বনেতৃত্বের ধ্বজাধারী হতে সাহায্য করেছে। বিশেষ করে তাদের নিজ ভূখণ্ডকে রক্ষা করার জন্য বিশেষ কোনো প্রস্তুতি নিতে হয় না, যা চীনের ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টো। চীনের পাশে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতি ও আঞ্চলিক শক্তি ভারত, যার সঙ্গে চীনের সীমান্তবিরোধ; রয়েছে তাইওয়ান, যাদের স্বাধীনতা রুখতে চীনকে সর্বদা গলদঘর্ম হতে হয়। চীনের পাশে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মতো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ, যারা যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষিত বন্ধু। চীনের সীমানা নিয়ে রয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে অস্বস্তিকর সম্পর্ক। এত সব সমস্যার সমাধান করে বিশ্বনেতৃত্বের আসন অলংকৃত করা প্রায় অসম্ভব।

আট. যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ সম্পর্ক: এখন পর্যন্ত ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে সমন্বিতভাবে বিশ্ব অর্থনীতির স্তম্ভ বলা যায়, যার নেতৃত্বে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলোর অকুণ্ঠ সমর্থন। চীনের পক্ষে তার অতিদ্রুত ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অগ্রগতি দিয়েও এই সমন্বিত অর্থনীতিকে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়, যা বিশ্বমোড়ল হতে চীনকে ঠেকিয়ে দেবে। ভবিষ্যৎ বলে দেবে, চীন কীভাবে এসব বাধা মোকাবিলা করে বিশ্বনেতৃত্বের আসন অলংকৃত করে। 

শিক্ষক ও রাজনীতি গবেষক