প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

বিশ্ব সমাজকর্ম দিবস ও আমাদের প্রত্যাশা

শাহ মুনতাসির হোসেন মিহান : একটি সমাজ ব্যবস্থাপনায় যে কাজের মাধ্যমে সমাজের ইতিবাচক ও গঠনগত পরিবর্তন করে সমাজের আমূল চিত্র বদলে ফেলা হয় তাই হচ্ছে সমাজকর্ম। সমাজকর্ম হচ্ছে বিশেষায়িত পেশা। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ ও মানুষের মধ্যকার সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করে সমাজকর্ম। সমাজকর্ম সমাজের সনাতনী চিন্তাভাবনার পরিবর্তন করে বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োগ করে মানুষের চিন্তাভাবনাতে পরিবর্তন আনে। সমাজকর্ম বিষয়ে জ্ঞান অর্জনকারী ব্যক্তি বা সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিকে সমাজকর্মী নামে অভিহিত করা হয়। আধুনিক বিশ্বে হাতেগোনা কয়েকটি বিষয় হচ্ছে পেশাকেন্দ্রিক বিষয়। তš§ধ্যে সমাজকর্ম বিষয় অন্যতম। সমাজের ভিত্তি স্থাপন ও কাঠামোগত ভিত মজবুত করে সমাজকর্মীরা। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সমাজের সঠিক পরিচর্যা ও ভিত্তি গঠিত হয় সমাজকর্মীর মাধ্যমে। সমাজের বিশেষ লক্ষ্য পূরণ ও চিহ্নিত সমস্যা সমাধান করে একটি আদর্শ সমাজ বা সম্প্রদায় গঠন করাই হচ্ছে সমাজকর্মের মুখ্য উদ্দেশ্য।

একটি দেশের যথাযথ উন্নতির লক্ষণ দৃশ্যমান হয় স্থানীয় সমাজে উন্নয়নের মাধ্যমে। সামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষার মান উন্নয়ন, মানবিক সম্পর্ক ত্বরান্বিতকরণ, মানবাধিকার চাহিদা পূরণ প্রমুখ বিষয় দেশের স্থায়ী কাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে দেশের আলাদা দৃষ্টান্ত তৈরি করে।  উন্নত বিশ্বে এ কাজগুলো সম্পাদন করে একজন পেশাদার সমাজকর্মী। যার জন্য উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সামাজিক সমস্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে যে, দেশগুলোর অপরাধ প্রতিনিয়ত কমছে। এতে ওই দেশগুলোর পুনর্বাসন কেন্দ্র, অপরাধ নির্মূল কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ওই দেশগুলোর এ অবস্থানে নিয়ে আসার মূল কারিগর হচ্ছে পেশাদার সমাজকর্মীরা।

প্রতি বছর মার্চ মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার সমাজকর্মের প্রচার, প্রসার ও মানব সম্পর্কের উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় বিশ্ব সমাজকর্ম দিবস। এ বছরের বিশ্ব সমাজকর্ম দিবস পালন করা হবে আজ। উন্নত বিশ্বের ন্যায় আমাদের দেশেও প্রতি বছর সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালন করা হয় বিশ্ব সমাজকর্ম দিবস। প্রযুক্তির বদৌলতে সময় যখন প্রতিনিয়ত আধুনিকতর হচ্ছে। তখন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সমাজের সমস্যাগুলো। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেও ক্রমাগত সামাজিক সমস্যা বাড়ছে। যৌতুক, বাল্যবিয়ে, খুন, অপরাধ, ধর্ষণ, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, মানবাধিকার ও নিরাপত্তাজনিত সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব সমস্যার জন্য আমাদের সমাজের ভিত্তিমূলের অবস্থা তথৈবচ। তাছাড়া আমাদের দেশে এ বিশেষ চিহ্নিত সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর পেশাদার সমাজকর্মী নেই। এখনও আমাদের দেশে পেশাদার সমাজকর্মীদের স্বীকৃতি প্রদানের সংস্কৃতি ও প্রক্রিয়া গঠন করা হয়নি। বিষয়টি সমাজকর্ম স্নাতকদের জন্য হতাশাজনক। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পেশাদার সমাজকর্মী তার অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা, কলাকৌশল, দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের উপযুক্ত ক্ষেত্র পেলেও আমাদের দেশের গ্র্যাজুয়েটপ্রাপ্ত সমাজকর্মীদের কাছে এখনও সেই ক্ষেত্রটি অধরা। আমাদের দেশে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ সমাজকর্মী সরবরাহ করা হলে সমাজের গুরুতর সমস্যাগুলো সমাধানের পাশাপাশি সমাজের সব মানুষ নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তোলার পরিপূর্ণ পরিবেশ পাবে।

আমাদের দেশের আটটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি কলেজগুলোতে পড়ানো হচ্ছে সমাজকর্ম বিষয়টি। আমাদের দেশে পেশাদার সমাজকর্মীদের স্বীকৃতিহীনতার কারণে সমাজকর্ম পূর্ণ মাত্রা পাচ্ছে না। কিন্তু দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় একজন দক্ষ সমাজকর্মীর গুরুত্ব অপরিসীম। একজন দক্ষ সমাজকর্মী সমাজের বিশেষ সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও কাজ করবে। তাছাড়া একজন বৈজ্ঞানিক গবেষণানির্ভর সমাজকর্মী সমাজের প্রতিটি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা ও মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা নিয়েও কাজ করতে পারবে। এতে আমাদের মানুষের  আর্থসামাজিক জীবনযাত্রার মান পরিশীলিত হবে। তাছাড়া চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সময় আসন্ন। ইতোমধ্যে সরকারও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতি নিতে বলেছে সবাইকে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও সরকার ঘোষিত ঘোষিত রূপকল্প-২০৪১ অর্জনে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারবে পেশাদার সমাজকর্মীরা।

কিন্তু আমাদের দেশে সমাজকর্মের প্রচলনের এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও সমাজকর্মের স্বীকৃতি অর্জন এখনও মেলেনি। তাই এ বছরের বিশ্ব সমাজকর্ম দিবসে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো ন্যায় আমাদের দেশেও সমাজকর্মকে পেশা হিসেবে  স্বীকৃতি দেয়ার যাবতীয় প্রক্রিয়া গ্রহণ করা অতীব জরুরি। সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদপ্তর, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় প্রভৃতি প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়গুলো সমাজকর্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেজন্য এই মন্ত্রণালয়গুলোর নিয়োগ পরীক্ষায় গ্র্যাজুয়েট সমাজকর্মদের মূল প্রাধান্য দিতে হবে। ইউনিয়ন সমাজকর্মী, উপজেলা সমাজসেবা অফিসার, জেলা সমাজসেবা অফিসার এ পদগুলোতে স্নাতকধারী সমাজকর্মদের জন্য সংরক্ষিত করতে হবে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে সমাজকর্মে স্নাতকদের জন্য উচ্চতর শিক্ষা অর্জনে বিভিন্ন স্কলারশিপ চালু করতে হবে। তাছাড়া প্রতিটি সমাজকর্মীকে সরকারিভাবে নিবন্ধিত হওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে একজন সমাজকর্মী ব্যক্তিগত উদ্যোগে ডাক্তার প্রকৌশলী, শিক্ষকের মতো সমাজের গঠনগত পরিবর্তন আনয়নে কাজ করতে পারে। বিশ্ব সমাজকর্ম দিবসে একজন সমাজকর্ম হিসেবে পড়ুয়া শিক্ষার্থী হিসেবে প্রত্যাশা ও আশাবাদ ব্যক্ত করি যে অচিরেই সমাজকর্মের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে লাভবান হবে সমাজের প্রতিটি মানুষ। সমাজের মানুষ হয়ে উঠবে আরও সৃজনশীল আধুনিকমনস্ক স্বশিক্ষিত। এটাই হোক বিশ্ব সমাজকর্ম দিবসের প্রকৃত প্রতিপাদ্য ও সেøাগান।

শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়