প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

বুয়েটের গবেষণা: প্রচলিত চুলায় গ্যাসের অপচয় দ্বিগুণ

নাজমুল হুসাইন: আবাসিক এলাকায় ব্যবহৃত প্রচলিত ধারার চুলায় অপচয় হচ্ছে অর্ধেকের বেশি গ্যাস। মূলত নিম্নমানের ভুল প্রযুক্তির চুলা ব্যবহার এ অপচয়ের প্রধান কারণ। এতে দৈনিক আবাসিক সংযোগে দেওয়া প্রায় ২৪ কোটি ৪৮ লাখ ঘনফুট গ্যাসের প্রায় অর্ধেকের বেশি অপচয় হচ্ছে। অপচয় বন্ধ করা গেলে উৎপাদন না বাড়িয়েও বর্তমান চাহিদার সমান গ্যাস সরবরাহ করা যায়। কিন্তু তা করার উদ্যোগ না নিয়ে নতুন গ্রাহকদের গ্যাস-সংযোগ বন্ধ রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করা হচ্ছে।

গ্যাস অপচয়ের এমন চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাম্প্রতিক এক গবেষণায়। প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার অংশ হিসেবে সম্প্রতি বুয়েটের কেমিক্যাল বিভাগে ১৮টি আবাসিকে ব্যবহৃত গ্যাসের চুলা পরীক্ষা করা হয়। দেশের বাজার থেকে সংগ্রহ করা এসব প্রচলিত চুলার মধ্যে ১০টি ছিল চীন থেকে আমদানি করা চুলাসহ আটটি দেশি প্রযুক্তিতে তৈরি চুলা। সংগ্রহ করা মোট চুলার অর্ধেক ডাবল বার্নারের ও অর্ধেক সিঙ্গেল বার্নারের।

প্রতিবেদনে বলা হয়, পরীক্ষা করা চুলাগুলোর উদ্বেগজনক হারে গ্যাস অপচয় করছে। প্রচলিত কোনো ধরনেরই চুলা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের নির্ধারিত মান ও শর্ত পূরণ করছে না। উল্টো এসব চুলায় অপচয় হচ্ছে দ্বিগুণের বেশি গ্যাস। যেখানে তিতাসের শর্ত অনুয়ায়ী আবাসিকে ব্যবহৃত ডাবল বার্নার চুলার প্রতি ঘণ্টায় গ্যাস খরচ করবে ২১ ঘনফুট। সেখানে পরীক্ষাকৃত ৯টি চুলার প্রতি ঘণ্টায় গ্যাস খরচের পরিমাণ ছিল সর্বনিম্ন ২৯ দশমিক ১৬ ঘনফুট। আর সর্বোচ্চ এসব চুলা গ্যাস খরচ করছে প্রতি ঘণ্টায় ৫৮ দশমিক ৮৩ ঘনফুট পর্যন্ত।

একইভাবে সিঙ্গেল চুলায় তিতাসের গ্যাস খরচের মাত্রা প্রতি ঘণ্টায় ১২ ঘনফুট নির্ধারিত। তবে পরীক্ষা করা ৯টি চুলার সর্বনিম্ন গ্যাস খরচ প্রতি ঘণ্টায় ১৪ দশমিক ৩ ঘনফুট আর সর্বোচ্চ মাত্রা ৩০ দশমিক ৮২ ঘনফুট। এদিকে পরীক্ষা করা চুলাগুলোর মধ্যে চীনের আমদানি করা চুলার গ্যাসের অপচয়ের মাত্রা বেশি। ডাবল বার্নারের পাঁচটি চীনের তৈরি চুলার মধ্যে গ্যাসের খরচ প্রতি ঘণ্টায় যথাক্রমে ৫৮ দশমিক ৮৩ ঘনফুট, ৪০ দশমিক ১৫ ঘনফুট, ৩৩ দশমিক ৬ ঘনফুট,  ৪৯ দশমিক ৮৭ ঘনফুট  ও ৪৮ দশমিক ৫৬ ঘনফুট। তবে দেশি প্রযুক্তিতে তৈরি চারটি চুলার গ্যাস খরচ প্রতি ঘণ্টায় ৪০ দশমিক ৭৯ ঘনফুট, ৩০ দশমিক ৩২ ঘনফুট, ২৯ দশমিক ৫৪ ঘনফুট ও ২৯ দশমিক ১৬ ঘনফুট।

গবেষণা পরিচালনাকারী বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মমিনুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন থেকেই বুয়েট জ্বালানি সাশ্রয়ে নানা ধরনের গবেষণা করছে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার অংশ হিসেবে আমরা এসব চুলার কর্মদক্ষতা পরীক্ষা করি। তবে দেশের এসব চুলার গ্যাস খরচের মাত্রা ছিল খুবই উদ্বেগজনক। বিশেষ করে ত্রুটিপূর্ণ প্রযুক্তি ও নিম্নমানের যন্ত্রাংশের কারণে এ অপচয় হচ্ছে। এ হিসাবে দেশে যে পরিমাণ গ্যাস আবাসিকে নষ্ট হচ্ছে, তা বাঁচানো গেলে আবাসিকে দ্বিগুণ গ্রাহককে গ্যাস দেওয়া সম্ভব।’

দেশে আবাসিকে ব্যবহৃত চুলাগুলোর কোনো নির্ধারিত মান নেই। কারণ চুলার মান তত্ত্বাবধায়ন নেই সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানই। নিজের ইচ্ছেমতো প্রযুক্তিতে দেশে তৈরিসহ চীন থেকে চুলা আমদানি করে দেশের বাজারে সরবরাহ করছে শতাধিক কোম্পানি। তবে নিম্নমানের এসব চুলা যে পরিমাণে গ্যাস খরচ করছে, তা বিশ্বের যে কোনো দেশের স্ট্যান্ডার্ডের তুলনায় অনেক বেশি। এমনকি এসব চুলার মান ও কর্মক্ষমতাও প্রশ্নবিদ্ধ।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) জ্বালানি গবেষণা ও উন্নয়ন ইনস্ট্রিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুর রউফ বলেন, ‘প্রচলিত চুলায় গ্যাস অপচয়ে আমরাও একমত। শুধু গ্যাস অপচয়ই নয়, এসব চুলার কার্যকারিতাও সঠিক নয়। যত্রতত্র সস্তা মানের চুলা ব্যবহার হচ্ছে দেশে। যার মান নিয়ন্ত্রণ দরকার। সঠিক প্রযুক্তিতে তৈরি চুলা ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের গ্যাস অপচয় অনেক অংশেই কমানো সম্ভব।’

তিতাস সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে গ্যাস চাহিদার পরিমাণ দৈনিক ৩২০০ মিলিয়ন ঘনফুটের অধিক। এর বিপরীতে দৈনিক গড়ে প্রায় ২৭৪০ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে সারা দেশে আবাসিক গ্রাহক মোট উৎপাদনের ১২ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার করেন। দেশে আবাসিকে নতুন সংযোগ বন্ধের আগে পর্যন্ত প্রায় ২২ লাখ গ্রাহক গ্যাস ব্যবহার করছেন। গড়ে প্রতিদিন এসব গ্রাহক প্রায় ২৪ কোটি ৪৮ লাখ ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার করেন।

এদিকে গ্যাস সরবরাহ করলেও তিতাস চুলার বিষয়ে কোনো রকম তদারকি করেন না জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী এইচএম আলী আশরাফ বলেন, তিতাসের তদারকি গ্যাসের লাইন পর্যন্ত। আইনে চুলায় তিতাসের কোনো কর্তৃত্ব নেই। চুলার মান নিয়ে দেশের মান তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করতে পারে।’

এদিকে দেশের জাতীয় মান সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্স অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) বলছে, তাদের বাধ্যতামূলক পণ্যের তালিকায় গ্যাসের চুলা নেই। যেসব পণ্য বা উপকরণ বা যন্ত্রাংশ তাদের তালিকায় রয়েছে সেগুলোর মান তারা দেখভাল করছেন। তবে তালিকাবহির্ভূত পণ্য তাদের নজরদারিতে নেই।

কয়েক বছর আগেও তিতাস করা এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছিল যে তিতাসের আওতাধীন এলাকার আবাসিক গ্রাহকদের ব্যবহৃত চুলা জ্বালানি ব্যবহার দক্ষ ও সব ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে প্রতিদিন আরও প্রায় পাঁচ কোটি ঘনফুট গ্যাস সাশ্রয় করা সম্ভব।