নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের পুঁজিবাজারে বিতর্কিত ব্যক্তি কামরুল হাসান। তিনি মার্চেন্ট ব্যাংক এনআরবি ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের পরিচালক থাকাকালে পোশাক খাতের কাট্টলী টেক্সটাইল লিমিটেড পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। তখন নিজের আত্মীয়স্বজনের নামে প্লেসমেন্ট শেয়ার বরাদ্দ নেন, যা রিলেটেড পার্টি ট্রানজেকশন কোড লঙ্ঘন করে। এ তথ্য জেনে নীরব ছিল খোদ কমিশন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পুঁজিবাজারে অতিপরিচিত মুখ কামরুল হাসান। তিনি ২০২০ সাল পর্যন্ত এনআরবি ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্টের পরিচালক ছিলেন। তিনি পরিচালক পদে থাকাকালে অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন লিমিটেড, কাট্টলি টেক্সটাইল লিমিটেড, লুব রেফ (বিডি) লিমিটেড, ই-জেনারেশন, ডমিনেস স্টিলসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্তির কাজ করেন। এ সময়ে পরিচালক পদে থাকাকালে কাট্টলি টেক্সটাইল লিমিটেডের নিজের আত্মীয়স্বজনের নামে বিপুল পরিমাণে শেয়ার বরাদ্দ নেন। এর মধ্যে চাচা হোসাইন মোহাম্মদ শফিউল্লাহর নামে ১৬ লাখ ৪০ হাজার ২০০ শেয়ার, শফিউল্লাহর স্ত্রী অর্থাৎ কামরুলের চাচি কিসমত আরার নামে ৬ লাখ ৫ হাজার শেয়ার এবং আরেক আত্মীয় এসকে রোজাউল করিমের নামে ১১ লাখ ৫৯ হাজার ৬৬৫টি শেয়ার বরাদ্দ নেন। অর্থাৎ ৩৪ লাখ চার হাজার ৮৬৫টি শেয়ার তিনি স্বজনদের বরাদ্দ নেন। এর মধ্যে ম্যাট্রিক্স এগ্রো অ্যান্ড ফিশারিজ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কামরুল হাসান ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং হোসাইন মোহাম্মদ শফিউল্লাহ চেয়ারম্যান হিসাবে আরজেসিতে নিবন্ধন নেন, যা পুরোপুরি করপোরেট গভর্ন্যান্স ভায়োলেশন।
এছাড়া আরও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন কোম্পানির প্রি-আইপিও শেয়ার বিক্রির নাম করে ১৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা লুটপাটের অভিযোগে এনআরবি ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড একাধিক মামলা করেছিল। এ মামলায় তিনি ১৭ মাস কারাগারে ছিলেন।
কামরুল হাসানের অর্থ স্বার্থের মামলার নথিতে বলা হয়, অভিযুক্ত কামরুল হাসান বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে নেয়া চেক নিজেই গ্রহণ করে, আবার নিজেই নিজ স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের চেক প্রদান করে। তা আবার কামরুলের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে তুলে নিত। অর্থাৎ ক্রস ট্রান্সজেকশন করে নিজেই ভোগ করত। যেমন কামরুল হাসান এনআরবি ইক্যুইটির চেক নিজের স্বাক্ষর করে তার মালিকানাধীন ম্যাট্রিস এগ্রো ফিশারিজের নামে নেয়া হয়। এছাড়া আত্মসাৎকৃত টাকায় ফ্ল্যাট, গাড়ি, গুলশান নর্থ ক্লাবে সদস্য পদ নেয়া, বিভিন্ন কোম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনা, ব্রোকারেজ হাউসে নিজ বিওতে বিনিয়োগ, বিদেশ ভ্রমণ ইত্যাদি কাজে অর্থব্যয় করেন।
এনআরবি ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড আর্থিক কার্যক্রম পরীক্ষার জন্য মেসার্স সিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোংকে (চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস) ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গভীরভাবে নিরীক্ষার জন্য গত ২০২০ সালে ৫ ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগ দেয়। যথারীতি ওই স্পেশাল অডিটর সার্বিক পরীক্ষান্তে তাদের নিরীক্ষিত রিপোর্টটি একই বছরের ২৪ মার্চ এনআরবি ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের কাছে দাখিল করেন। পরবর্তী পর্যায়ে ওই বহিঃঅডিটর রিপোর্ট অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে কোম্পানির শেয়ারসহ গ্রাহক ও কোম্পানির হিসাবে সর্বমোট ৩২ কোটি ৪৮ লাখ ৭৭ হাজার ৪৪৬ টাকার আর্থিক অনিয়ম ধরা পড়ে, যার পরিপ্রেক্ষিতে এনআরবি ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড কর্তৃক কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে সিআর মামলা ৬৮৫/২০২০ ও মানি মোকদ্দমা ৬১/২০২০ মামলা করেছিল। এ মামলায় ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন আসামি কামরুল। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এ বিষয়ে কাট্টলি টেক্সটাইল লিমিটেড, অ্যাসোসিয়েট অক্সিজেন ও লুব-রেফ (বিডি) লিমিটেডের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমরা কয়েকজন ব্যক্তি থেকে টাকা দিয়েও শেয়ার বরাদ্দ না পাওনার অভিযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু সেসব অভিযোগ সঠিক ছিল না। এমনকি আইপিও পাস হওয়ার পরও শেয়ার কেনার ভুয়া কাগজ দেখানো হয়। কারণ আমরা এসব ব্যক্তির কাছে থেকে শেয়ার বিক্রির জন্য কোনো টাকাপয়সাও গ্রহণ করিনি। সুতরাং শেয়ার বরাদ্দ না পাওয়া নিয়ে অভিযোগ পুরোপুরি অসত্য। আমাদের আইপিওতে আসার জন্য ইস্যু ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল এনআরবি ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানের একজন সাবেক পরিচালক কামরুল হাসান বিভিন্নজন থেকে শেয়ার দেয়ার নাম করে এসব অপকর্ম করেছিল বলে জানতে পারি।
এ বিষয়ে কামরুল হাসান বলেন, কাট্টলি টেক্সটাইলের আইপিওতে আসার সময় কোম্পানির জরুরি টাকার প্রয়োজনে আমার আত্মায়ীদের কাছে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা এনে দেয়, যা আইপিওর প্রসপেক্টাস নাম ছিল। এতে রিলেটেড পার্টি ট্রানফেকশনের নন-কমপ্লেইন্ট কোড লঙ্ঘন হয়েছিল। তবে এটা ইচ্ছা করে করা হয়নি।
এছাড়া আমার বিরুদ্ধে ৩২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে, যা পুরোপুরি ভুয়া। আমার একার সাইনে চেক পাস হয়নি। সব ডকুমেন্টস আছে। আর যারা অডিট করেছেন তারা এখন নিষিদ্ধ অডিটর। আর তারা আমার এনআরবি ইকুইটি শেয়ার কিনে নিতে চেয়েছিল, আমি সেল করতে রাজি হইনি। ফলে আমাকে নানানভাবে হয়রানি করা হচ্ছে।
অপরদিক বিএসইসি অতিরিক্ত পরিচালক শামসুর রহমান (জেনারেল) বলেন, আমরা এসব বিষয়ে তদন্ত করছি। আমরা এর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে তলব করছি। যদি এনআরবি ইকুইটির পরিচালক কামরুল হাসান রিলেটেড পার্টি ট্রানজেকশন কোড লঙ্ঘনসহ আরও অপরাধ করে থাকলে আমরা তদন্ত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসব।
প্রিন্ট করুন





Discussion about this post