প্রীতিরঞ্জন সাহা, নরসিংদী : ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদী সদর উপজেলার পাঁচদোনা ইউনিয়নের পাঁচদোনা গ্রামে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী ভাই গিরীশচন্দ্র সেনের বাড়িটি অবৈধ দখল এবং সৌন্দর্য বিনষ্টের চক্রান্ত করার অভিযোগ উঠেছে একটি মহলের বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে পার্শ্ববর্তী চৈতাব গ্রামের জনৈক ওয়াব মিয়া ও তার দলবল গিরীশচন্দ্র সেনের বাড়ির রাস্তার পাশঘেঁষা সম্মুখভাগের ভূমিতে স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেছেন। এ ব্যাপারে কেউ প্রতিবাদ করলে দখলদাররা দলবল নিয়ে প্রতিবাদকারীদের নানা ধরনের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হুমকি দিয়ে থাকেন। এতে নিরাপত্তাজনিত হুমকির কথা জানিয়েছেন গিরীশচন্দ্র সেন কেন্দ্রীয় স্মৃতি ও গবেষণা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি খন্দকার ফয়সাল আহমেদ।
ফয়সাল আহমেদ নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, গিরীশচন্দ্র সেনের বাড়িতে প্রবেশের জন্য উত্তর ও দক্ষিণ পাশের দুদিকের রাস্তায়ই ময়লা আবর্জনা ফেলে বাড়িটিতে প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। অথচ ১৫ শতাব্দীর দিকে এই রাস্তা সেন পরিবারসহ তাদের বাড়ির অন্যরা ব্যবহার করতেন। এখনও সে রাস্তাটি জনসাধারণ ব্যবহার করছেন। এলাকাবাসীর দাবি, প্রতœতাত্ত্বিক নির্দশন মনীষী গিরীশচন্দ্র সেনের বাড়িটি যেন সংরক্ষণ করা হয়। এখন যদি কোনো কারণে রাস্তাটি বন্ধ হয়ে যায়, তবে পর্যটক ও দর্শনার্থীরা চরম ভোগান্তির শিকার হবেন।
তিনি আরও জানান, গিরীশচন্দ্র সেন সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, গিরীশচন্দ্র সেন কেন্দ্রীয় স্মৃতি ও গবেষণা সংস্থাটি প্রায় ৩৫ বছর ধরে দেখভাল করা হচ্ছে, যা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে সবাই অবগত। ঐতিহাসিক এ ভবনটি অযতœ, অবহেলা ও বেদখল অবস্থায় যখন ধ্বংসপ্রাপ্ত, তখন ফয়সাল আহমেদ ও তার সঙ্গী-সাথিরা নিজ উদ্যোগে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও শিক্ষিত যুবকদের সমন্বয়ে ভবন সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ নেন। পরে তিনি বিষয়টি নরসিংদী জেলা প্রশাসন ও প্রতœতাত্ত্বিক বিভাগের দৃষ্টিগোচর করেন।
নরসিংদীর তৎকালীন জেলা প্রশাসক এবং ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী ও হর্ষবর্ধণ শ্রীংলার সমন্বয়ে তাদের দেয়া আর্থিক সহায়তায় প্রায় দুই শতাংশ ভূমির ওপর আদি আকৃতিতে এই ভবনটির কিয়দাংশ সংস্কার করা হয়। এখনো গিরীশ চন্দ্র সেনের বাড়ির আশেপাশে অনেক ভূমি অবৈধ দখলদারদের দখলে রয়েছে, যা অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার করা অতি জরুরি। বর্তমানে গিরীশচন্দ্র সেনের বাড়িটি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত। এ বাড়িটির যাবতীয় ঐতিহাসিক নিদর্শন জনসম্মুখে তুলে ধরার নিমিত্তে সরকার ও বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থার পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন বলে স্থানীয়রা মনে করেন।
গিরীশ চন্দ্র সেন ১৮৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯১০ সালের ১৫ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন একজন বাঙালি ধর্মবেত্তা, অনুবাদক ও বহুভাষাবিদ। ভাই গিরীশচন্দ্র সেন নামেই তিনি বেশি পরিচিতি পেয়েছেন এবং মৌলভী উপাধিও পেয়েছেন।

নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা গ্রামে তার জন্ম। পেশাগত জীবনের প্রথম পর্যায়ে তিনি ময়মনসিংহের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কাচারিতে নকলনবিশ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে স্বল্প সময়ের জন্য ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে শিক্ষকতা করে সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রথম পর্যায়ে তিনি ঢাকা প্রকাশে কাজ করেন এবং এতে তার লেখা প্রকাশিত হয়। পরে তিনি সুলভ সমাচার ও বঙ্গবন্ধু পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক এবং মাসিক মহিলা (১৩০২) পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ছাত্রজীবনে তিনি ফারসি ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেন। কেশবচন্দ্র সেন ও বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর প্রভাবে ১৮৭১ সালে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন এবং প্রচারব্রত গ্রহণ করে উত্তর ভারত, দক্ষিণ ভারত ও ব্রহ্মদেশ ভ্রমণ করেন। গুরু কেশবচন্দ্র সেনের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় তিনি ইসলামি সাহিত্য সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। এ উপলক্ষে আরবি ভাষা ও ইসলামিক ধর্মশাস্ত্র চর্চার জন্য তিনি ১৮৭৬ সালে লক্ষেèৗ গমন করেন। ধর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ, চারিত্রিক উদারতা এবং সত্যবাদিতার জন্য গিরীশচন্দ্র ব্রাহ্ম-হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান সবার শ্রদ্ধা অর্জন করেন। এককথায় তিনি ছিলেন সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রতীক। তাই সবার কাছে তিনি ‘ভাই গিরীশচন্দ্র’ নামে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি তার প্রকাশনী থেকে কোরান শরিফের বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেন।