পূর্বের প্রকাশের পর………
শেয়ারবাজারে কিছু মুহূর্তে চোখ বুজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন আপনি। কখনও কখনও আবার চোখ-কান খোলা না রাখলে সমূহ বিপদ। কখন চোখ বন্ধ রাখবেন, আর কখন খোলা রাখবেন সে বিষয়ে কিছু উপদেশ ঝেড়েছি। আর এ আলোচনায় বিনিয়োগকারীর সাইকোলজি সম্পর্কে বাক্যালাপ অবধারিত। একজন বিনিয়োগকারীর সবচেয়ে বড় শত্রু হলো তার মেজাজ ও মগজ। কথাটি বর্তমান সময়ে আরও বেশি প্রযোজ্য। মন্দা বাজারে রক্ষণশীল ভাব ধরে নিষ্ক্রিয় হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন, তা হবে না। বিনিয়োগ করতে চাইলে ভালো-মন্দ শেয়ার কিনতেই হবে আপনাকে। গায়ে লাগাতেই হবে মন্দা বাজারের উত্তাপ। আমার বিশ্বাস, কারও যদি মোটামুটি চলনসই জ্ঞান-বুদ্ধি থাকে, তিনি যদি আমার কথাগুলো আত্মস্থ করতে সমর্থ হন কাজে আসবে বইটি। সফল বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযুক্ত মানসিকতা গড়ে তুলতে পারবেন পাঠকরা। আমি কিন্তু বহু সাধারণ বিনিয়োগকারীকে ওয়ালস্ট্রিটে দেখেছি, যারা ফাইন্যান্স, অ্যাকাউন্টিং ও স্টক মার্কেটের ওপর বিশাল ডিগ্রিধারীদের চেয়ে ভালো করেছেন।
বিবেচনায় নিন মিউচুয়াল ফান্ডের ব্যয়, ঝুঁকি ও ম্যানেজারের সুনাম
সব মিউচুয়াল ফান্ডই কি বাজারের কাছে পরাজিত হয়? নিশ্চয়ই নয়। বরং বহু উদাহরণ রয়েছে মিউচুয়াল ফান্ডের সাফল্যের। তবে মিউচুয়াল ফান্ড যেহেতু একক সিদ্ধান্তনির্ভর প্রতিষ্ঠান; এর ব্যর্থতার দায় বা সাফল্যের অবদানও তাই ম্যানেজারের ওপরই বর্তায়। সফল বা প্রতিশ্রুতিশীল ম্যানেজারদের অভিন্ন কিছু গুণ বা লক্ষণ বিদ্যমান:
ম্যানেজার হবেন ফান্ডের সর্ববৃহৎ শেয়ারহোল্ডার: কিছু সিদ্ধান্ত ফান্ড ম্যানেজারদের ব্যক্তিগত আয়-উন্নতির জন্য ভালো আর কয়েকটি সিদ্ধান্ত রয়েছে, যেগুলো বিনিয়োগকারীর স্বার্থরক্ষার জন্য উপযুক্ত। এ উভয় উপাদানের মাঝে আবার রয়েছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বটি অনেকখানি মিটে যায় ম্যানেজারই ফান্ডটির সিংহভাগ
শেয়ারের স্বত্বাধিকারী হলে। উদাহরণ হিসেবে ওয়ালস্ট্রিটের লংলিফ পার্টনারসের কথা বলা যায়। নিজ কর্মীদের অন্য কোনো ফান্ডের শেয়ার কিনতেই দেয় না ফান্ডটি। আবার ডেভিস কিংবা এফপিএ’র মতো ফান্ডের ম্যানেজাররা এতো বেশি ফান্ড শেয়ার ধারণ করেন যে, ওসব ফান্ডে অন্যান্য বিনিয়োগকারীর শেয়ার থাকতে পারে তা মনেই হয় না কারও।
ট্রেডিং ও অপারেশনাল কস্ট সস্তাকরণের প্রতি মনোযোগ: তুমুল জনপ্রিয় ও প্রচলিত মিথ হলো, যত গুড় তত মিঠা ভালো ফান্ডের খরচ একটু বেশি। কথাটা সম্পূর্ণ উল্টো মিউচুয়াল ফান্ডের বেলায়। কয়েক দশকের গবেষণালব্ধ ফল দেখাতে পারি, যেগুলো বলছে, উচ্চতর ফি উত্তোলনকারী মিউচুয়াল ফান্ডই দেয় নিম্নতর রিটার্ন। তাছাড়া উচ্চতর রিটার্ন ক্ষণস্থায়ী; অথচ উচ্চতর ফি স্থিতিশীল। ভালো রিটার্নের আশায় ভালো ফান্ডে বিনিয়োগ করে কাক্সিক্ষত ফল নাও পেতে পারেন আপনি। কিন্তু তার উচ্চ ফি দিতে হবে। ফলে ভালো ম্যানেজাররা সাধারণত এসব ব্যয় হ্রাসে মনোযোগ দেন।
স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস: অন্যদের অনুসৃত পদ্ধতি প্রায়ই অনুসরণ করেন না সফল ফান্ড ম্যানেজাররা। তাদের পদ্ধতি পৃথক ও স্বতন্ত্র। যেমন : অন্যরা যেখানে ভালো শেয়ার ছাড়া কিনতেন না, ফিডেলিটি ম্যাগেলানের সফল ম্যানেজার পিটার লিঞ্চ কিনতেন শুধু সস্তা শেয়ার। ১৯৮২ সালে তিনি সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেন ইউএস ট্রেজারি বন্ডে। পরের বছর ফিডেলিটির পোর্টফোলিও ভরে যায় ক্রিজলার নামে গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে। অথচ সে সময় বহু বিশেষজ্ঞের সতর্কবার্তা ছিল, যে কোনো মুহূর্তে দেউলিয়া হতে পারে ক্রিজলার। তাদের সতর্কবার্তা ঘুণাক্ষরেও কর্ণপাত করেননি পিটার। আবার ১৯৮৬ সালে ফিডেলিটি ম্যাগেলানের মোট সম্পদের ২০ শতাংশ তিনি ব্যয় করেন হোন্ডা, নরস্ক হাইড্রো ও ভলভোর শেয়ার ক্রয়ে।
তারা থামতে জানেন: প্রায়ই নতুন বিনিয়োগকারী নিতে চান না সফল মিউচুয়াল ফান্ড ম্যানেজাররা। এরা পুঁজিলোভী নন। বরং রিটার্ন বেশি এলে নতুন ভাগিদার সৃষ্টি না করে তাদের লক্ষ্য থাকে পুরোনো ভাগিদারীদের মুনাফা বৃদ্ধির প্রতি। অতিরিক্ত বিনিয়োগকারীর বাড়তি প্রত্যাশার চাপ নিতে হয় না বলে স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তারা।
এরা প্রচারক নন: মহান গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তার ‘দ্য রিপাবলিক’ গ্রন্থে বলেছিলেন, সবচেয়ে ভালো শাসক হলেন তারাই, শাসন করতে চান না যারা। তেমনিভাবে সিংহভাগ সফল ফান্ড ম্যানেজার নিজ বেতন বৃদ্ধির ব্যাপারে মরিয়া নন; বিজ্ঞাপন প্রচারের দিকেও তাদের নজর কম। টিভি-রেডিওতে বা পত্রিকার সাক্ষাৎকারে তারা বুক চিতিয়ে বলেন না, ‘রিটার্নের দিক থেকে আমরাই নাম্বার ওয়ান।’ মায়ারস অ্যান্ড পাওয়ার গ্রোথ ফান্ড নামে এক সফল ফান্ডের কথা জানা যায়, ২০০১ সাল পর্যন্ত এদের কোনো ওয়েবসাইটও ছিল না। আর হাতেগোনা কয়েকটি (মার্কিন) রাজ্যে ছিল তাদের শাখা।
তাহলে কী দেখে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করবেন? অধিকাংশ বিনিয়োগকারী প্রথমে দেখেন ফান্ডের অতীত পারফরম্যান্স, তারপর ম্যানেজারের সুনাম, অতঃপর ফান্ডের ঝুঁকি ও সবশেষে ফান্ড ব্যয়। অথচ একজন বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীর দেখা উচিত পুরো উল্টোদিক থেকে। অর্থাৎ প্রথমে ফান্ড ব্যয়, তারপর এর ঝুঁকি, অতঃপর ম্যানেজারের সুনাম ও সবশেষে অতীত পারফরম্যান্স।
ক্লোজড-এন্ড ফান্ড নিয়ে দু-চারটি কথা না বললেই নয়। এগুলো মিউচুয়াল ফান্ড থেকে আলাদা। সরাসরি নতুন শেয়ার বিক্রির এখতিয়ার তাদের নেই। এরা বরং অন্য শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে শেয়ার এনে দেয় বিনিয়োগকারীকে। তার মানে, এখানে ফান্ডের দায় কম; শেয়ার পছন্দের ব্যাপারে বিনিয়োগকারীর পছন্দও সামান্য। ফলে ক্লোজড-এন্ড শেয়ারের দাম সাধারণত বিনিয়োগকারীর চাহিদা ও ফান্ডের সরবরাহ অনুযায়ী নিট অ্যাসেট ভ্যালুর উপর ও নিচে ওঠানামা করতে থাকে। এ ধরনের ফান্ড বেশ জনপ্রিয় ছিল ১৯৮০’র দশকে। ধীরে ধীরে এদের গুরুত্ব কমে যায়। পাশাপাশি এদের সংখ্যাও কমে যায়। এখন গুটিকয়েক আছে, তাদের আকার ক্ষুদ্র; দৈনিক লেনদেনও কয়েকশ’র বেশি হবে না। অথচ এগুলোর পরিচালন ব্যয় ও ট্রেডিং কস্ট বেশি এবং বিনিয়োগ কৌশল খাপছাড়া। যেমন, মরগ্যান ফানশেয়ার নামে এক ক্লোজড-এন্ড ফান্ড আছে যারা মদ, ক্যাসিনো, সিগারেট কোম্পানি ছাড়া বিনিয়োগ করে না অন্য কোথাও। মনে রাখা দরকার, বৈচিত্র্য রয়েছে এমন ক্লোজড-এন্ড স্টক ফান্ড যদি ডিসকাউন্টে কেনা যায়, তাহলে এরা প্রিমিয়ামে লেনদেনকারী মিউচুয়াল ফান্ডের গড় মুনাফার চেয়েও ভালো মুনাফা দেয় সাধারণত। ঝামেলা হলো, অধিকাংশ সময়ই বৈচিত্র্য থাকে না ক্লোজড-এন্ড ফান্ডে। তদুপরি মেলে না ডিসকাউন্ট (ছাড়)। ইদানীং আবার নতুন এক ধরনের ক্লোসড-এন্ডে ফান্ড দেখা যাচ্ছে, যাদের বলা হচ্ছে এক্সচেঞ্জ-ট্রেডেড ইনডেক্স ফান্ড (ইটিএফ)। সংকীর্ণ বাজারে (ন্যারো মার্কেট) প্রবেশের জন্য এগুলো কার্যকর (যেমন পাঠকদের কেউ যদি বেলজিয়ামের কোনো লাভজনক প্রযুক্তি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে চান, সেক্ষেত্রে ইটিএফ ব্যবহার করা ভালো)।
সর্বশেষ কথা হলো, বর্তমানে আপনি যদি মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করে থাকেন এবং আপনার ফান্ডটি যদি লাভজনক না হয়, তাহলে কী করণীয়? কখন মিউচুয়াল ফান্ড থেকে বেরিয়ে আসা উত্তম? অনেকে বলেন, এক বা দুই বা তিন বছর দেখুন, পারফরম্যান্স সন্তোষজনক না হলে সোজা কেটে পড়ুন ওই মিউচুয়াল ফান্ড থেকে। আমি এ ধরনের পক্ষপাতী নই। কেননা বাজার-প্রভাব থেকে কোনোভাবেই মুক্ত নয় মিউচুয়াল ফান্ড। ব্যক্তি বিনিয়োগের মতোই বাজারের উত্থান-পতন দ্বারা আক্রান্ত হয় এগুলো। ফলে নির্দিষ্ট করে বেরিয়ে আসার সময় নির্ধারণ কঠিন। আরেকটি বিষয় আছে। মন্দা বাজারে হুট করে মিউচুয়াল ফান্ড থেকে বেরিয়ে আসার অন্যতম ফল হতে পারে, আর্থিক ক্ষতি তো গুনতেই হবে। উপরন্তু পুনরুদ্ধারের পথও বন্ধ হয়ে যাবে বিনিয়োগকারীর জন্য। তবে মিউচুয়াল ফান্ডের বাজে পারফরম্যান্সের কিছু লাল পতাকা আছে, সেগুলো দেখামাত্র সরে পড়া উচিত:
এক. বিনিয়োগ কৌশলে আকস্মিক ও বিপরীতধর্মী পরিবর্তন: যে কৌশলে ভ্যালু ফান্ডগুলো ১৯৯৯ সালে প্রযুক্তি শেয়ার কেনার উদ্যোগ নেয় কিংবা যেভাবে গ্রোথ ফান্ডগুলো ২০০২ সালে বিমা শেয়ার (ইন্স্যুরেন্স স্টক) কেনে।
দুই. ব্যয়াধিক্য: ফান্ডের ব্যয় বাড়লেই বুঝবেন, সম্ভবত নিজেদের পকেট ভারী করছেন ম্যানেজাররা।
তিন. বড়সড় ও ঘন ঘন কর: অতিরিক্ত লেনদেন দ্বারা এর সৃষ্টি।
চার. হঠাৎ খেয়ালি রিটার্ন: আগে হয়তো ফান্ডটি রক্ষণশীল (বা মিতব্যয়ী) ছিল; কিন্তু সম্প্রতি বড় ধরনের লোকসানে পড়ে অত্যন্ত কম রিটার্ন দিয়েছে অথবা অজানা কারণে বিরাট রিটার্ন দিচ্ছে; উভয়ই সন্দেহজনক।
মনে রাখবেন সর্বাধিক সফল ফান্ডে আমার বিনিয়োগ আছে, এটা সুখকর অনুভূতি জাগায় মনে। এও ভাবতে খারাপ লাগে না যে, আমিই আমার ভবিষ্যৎ নিয়ন্তা। নিজেকে সবকিছুর নিয়ন্ত্রকের আসনে বসানোর মজাই অন্যরকম। দুর্ভাগ্যবশত, একেই ‘অতি-আত্মবিশ্বাস’ (ওভারকনফিডেন্স) হিসেবে উল্লেখ করেন মনোবিজ্ঞানীরা। সুইডেনে এক গবেষণা হয় সড়ক দুর্ঘটনার মূল্যায়ন নিয়ে। তাতে দেখা যায়, যেসব চালক অন্য চালকদের চেয়ে নিজেকে দক্ষতর মনে করতেন, কম দক্ষতাসম্পন্ন চালকদের চেয়ে অধিক প্রাণঘাতী তাদের দ্বারা সংঘটিত দুর্ঘটনাগুলোই। কথাটি মিউচুয়াল ফান্ড বাছাইয়ে আরও বেশি প্রযোজ্য।