পূর্বের প্রকাশের পর…….
শেয়ারবাজারে কিছু মুহূর্তে চোখ বুজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন আপনি। কখনও কখনও আবার চোখ-কান খোলা না রাখলে সমূহ বিপদ। কখন চোখ বন্ধ রাখবেন, আর কখন খোলা রাখবেন সে বিষয়ে কিছু উপদেশ ঝেড়েছি। আর এ আলোচনায় বিনিয়োগকারীর সাইকোলজি সম্পর্কে বাক্যালাপ অবধারিত। একজন বিনিয়োগকারীর সবচেয়ে বড় শত্রু হলো তার মেজাজ ও মগজ। কথাটি বর্তমান সময়ে আরও বেশি প্রযোজ্য। মন্দা বাজারে রক্ষণশীল ভাব ধরে নিষ্ক্রিয় হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন, তা হবে না। বিনিয়োগ করতে চাইলে ভালো-মন্দ শেয়ার কিনতেই হবে আপনাকে। গায়ে লাগাতেই হবে মন্দা বাজারের উত্তাপ। আমার বিশ্বাস, কারও যদি মোটামুটি চলনসই জ্ঞান-বুদ্ধি থাকে, তিনি যদি আমার কথাগুলো আত্মস্থ করতে সমর্থ হন কাজে আসবে বইটি। সফল বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযুক্ত মানসিকতা গড়ে তুলতে পারবেন পাঠকরা। আমি কিন্তু বহু সাধারণ বিনিয়োগকারীকে ওয়ালস্ট্রিটে দেখেছি, যারা ফাইন্যান্স, অ্যাকাউন্টিং ও স্টক মার্কেটের ওপর বিশাল ডিগ্রিধারীদের চেয়ে ভালো করেছেন।
টানা লভ্যাংশ দেয় উচ্চ মানসম্পন্ন কোম্পানি
এবার আসা যাক কোম্পানির পুঁজিকাঠামোয়। কোম্পানির ব্যালান্স শিট দেখুন। লক্ষ করুন, প্রেফারড স্টকসহ মোট কত ঋণ রয়েছে উদ্দিষ্ট কোম্পানির। স্বাভাবিকভাবে একটি কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি ঋণ তার মোট পুঁজির ৫০ শতাংশের কম হওয়া উত্তম। নজর দিন আর্থিক বিবৃতির ফুটনোটগুলোয়। সেখানে ছোট্ট করে ঋণের প্রকৃতি লেখা থাকার কথা। যদি দীর্ঘমেয়াদি ফিক্স-রেট (স্থিতিশীল সুদের হারে পরিশোধযোগ্য) ঋণ থাকে, তাহলে সুবিধা হলো মূল্যস্ফীতি বা বাজারে সুদের হার নিয়ে দুশ্চিন্তা কম। কিন্তু যদি ভ্যারিয়েবল (সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনশীল সুদের হার) ঋণ থাকে, তাহলে মুদ্রানীতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানির আয় কিন্তু বাড়বে বা কমবে। আরও দেখুন রেশিও অব আর্নিং টু ফিক্সড চার্জেস। অ্যামাজন ডটকমের ২০০২ সালের রেশিও অব আর্নিং টু ফিক্সড চার্জেসে নজর দিলে বোঝা যায়, ঋণ সার্ভিসিংয়ের দিক থেকে ১৪৫ মিলিয়ন ডলার ঘাটতি ছিল অ্যামাজনের। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দুটি উপায় থাকে। এক. হয়, ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির মাধ্যমে আয় বাড়ানো; দুই. নয়তো, স্বল্পসুদে নতুন ঋণ অনুসন্ধান। নইলে কোম্পানির মালিকানা শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে চলে যেতে পারে বন্ডহোল্ডারদের হাতে। সেক্ষেত্রে বিপত্তি হলো, বন্ডহোল্ডাররা যদি আপত্তি তোলেন মুনাফা ঠিকমতো পাচ্ছি না কোম্পানি বেচে শোধ করতে হবে সেই মূল্য। ফলে উদ্বৃত্ত ক্যাশ রয়েছে এমন একটা কোম্পানির শেয়ার, শেয়ারপ্রতি আয় বেশি কিন্তু ব্যাপক ঋণগ্রহণকারী তেমন কোম্পানির শেয়ারের তুলনায় ভালো। পাশাপাশি মাথায় রাখা দরকার, কোনো কোম্পানির সহনীয় মাত্রার বন্ড ও প্রেফারড স্টক থাকা দোষণীয় নয়। আবার মৌসুমি ঋণগ্রহণকারী ও পরিশোধকারী কোম্পানি থেকে দূরত্ব বজায় রাখাটাও অনর্থক। তবে যদি দেখা যায়, কোম্পানিটি মাথাভারী অর্থাৎ ওপরে বন্ডের পরিমাণ বেশি আবার নিচে কমন স্টকের সংখ্যা কম, তাহলে কিন্তু একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না ফাটকাবাজির মাধ্যমে বড় মুনাফা অর্জনের কুমতলব।
ডিভিডেন্ড রেকর্ড: যে কোনো উচ্চ মানসম্মত কোম্পানির লক্ষণ হচ্ছে, টানা কয়েক বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে বিনিয়োগকারীকে ডিভিডেন্ড পরিশোধ করবে এরা। আমার পরামর্শ হচ্ছে, এই ‘টানা কয়েক বছর’টা ২০ বছর হলে ভালো হয়। অবশ্য ডিভিডেন্ড রেকর্ড দেখে শেয়ার নির্ধারণ রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারীর জন্য উপযুক্ত কৌশল।
চলতি ডিভিডেন্ড হার: আগে চলতি ডিভিডেন্ড হার থেকে কোনো কোম্পানির স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কসরত করতে হতো বেশ। পরিশ্রমটি সাশ্রয় হয়েছে বর্তমানে সিংহভাগ কোম্পানির স্ট্যান্ডার্ড ডিভিডেন্ড পলিসি থাকায়। এই নীতির অনুসরণে গড় আয়ের দুই-তৃতীয়াংশ ডিভিডেন্ড হিসেবে শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বণ্টন করে দেয় কোম্পানি। অবশ্য মূল্যস্ফীতি বেশি থাকলে এবং চলতি কর আইনের সীমাবদ্ধতায় কম হতে পারে সংখ্যাটি। কেউ কেউ ডিভিডেন্ড পেআউট রেশিও-ও বলে থাকেন এতে। তারপর দেখতে হবে কোম্পানির ডিভিডেন্ড ও আয়ের সম্পর্কটি স্বাভাবিক কি না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো প্রতিশ্রুতিশীল কোম্পানির গড় প্রত্যাশিত আয় ৩ ডলার ও প্রত্যাশিত ডিভিডেন্ড ২ ডলার হলে কোম্পানির শেয়ারদর হতে পারে আয়ের সর্বোচ্চ ১২ গুণ বা ডিভিডেন্ডের সর্বোচ্চ ১৮ গুণ (উভয় ক্ষেত্রে ইল্ড হবে ৩৬ গুণ)। বাজারে শেয়ারটির দাম তার বেশি হলে সেটি না কেনাই ভালো। যে কারণেই হোক, সিকিউরিটি অ্যানালিস্টরা প্রায়ই আলোকপাত করেন গ্রোথ স্টকের ওপর। বিভিন্ন পদ্ধতি ও সমীকরণ থেকে গ্রোথ স্টকের যৌক্তিক মূল্য নির্ণয়ের সংক্ষিপ্ত একটি সূত্র বের করেছি আমি।
গ্রোথ স্টকের মূল্য= চলতি (স্বাভাবিক) আয় গুণ (৮.৫+ প্রত্যাশিত বার্ষিক প্রবৃদ্ধি গুণ ২)।
রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারীরা হয়তো স্বীকার করতে চাইবেন এতটা কষ্ট। তবে আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারীর অবশ্যই আন্তখাত ও আন্তখাতভিত্তিক শেয়ার বিশ্লেষণ করা উচিত। অর্থাৎ প্রথমে বিভিন্ন খাতের মধ্যে তুলনা, তারপর একই খাতের বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে মূল্যায়ন এবং শেষে একই কোম্পানির বিভিন্ন সময়ের আর্থিক অবস্থান বিশ্লেষণ। এটা অত্যাবশ্যক নয়। তবে এর মধ্য দিয়ে খাতওয়ারি ভালো শেয়ার নির্বাচনের কলাকৌশল শেখার সুযোগ আছে। আরও বড় কথা হলো, যত বেশি ও গভীরভাবে সিকিউরিটি অ্যানালাইসিস করবেন, ততই বাড়বে আত্মবিশ্বাস। আর যে কোনো বিনিয়োগের জন্য আত্মবিশ্বাস অপরিহার্য।
শেয়ারপ্রতি আয় নিয়ে কিছু কথা
শেয়ারপ্রতি আয় (পার-শেয়ার আর্নিং) নিয়ে দুটি উপদেশ দিয়ে শুরু করতে চাই চলতি অধ্যায়। উপদেশ দুটি বলতে সহজ। তবে বাস্তবে প্রয়োগের বেলায় উপদেশ দুটির বিরোধাত্মক (বা দ্বন্দ্বপূর্ণ) অবস্থান উপলব্ধি না করে পারবেন না বিনিয়োগকারী। উপদেশ নম্বর এক. কোনো কো¤‹ানির শুধু কোনো এক বছরের আর্নিংকে (আয়) সিরিয়াসলি নেবেন না কখনোই। দুই নম্বর উপদেশ, যদি কোনো কো¤‹ানির দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ অনুমানের উপায় না থাকে কিংবা কোনো কো¤‹ানির স্বল্পমেয়াদি রেকর্ড থেকে ভবিষ্যৎ প্রাক্কলনে বাধ্য হলে অবশ্যই খুঁজে পেতে চেষ্টা করবেন স্বল্পমেয়াদি শেয়ারপ্রতি আয় ফিগারের মধ্যে লুকানো আর্থিক ফাঁদ (ফাইন্যান্সিয়াল ট্র্যাপ)। লক্ষ করবেন, আমার প্রথম উপদেশ যদি কেউ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন, তবে তার জন্য দ্বিতীয় উপদেশ নিষ্ক্রয়োজন। অবশ্য এটা আদর্শ পরিস্থিতিতে। এখানে আমরা ধরে নিচ্ছি, উদ্দিষ্ট কোম্পানির এরই মধ্যে কয়েক দশক অতিবাহিত করেছে শেয়ারবাজারে এবং জন্মলগ্ন থেকে ওই কোম্পানির সংক্রান্ত সব আর্থিক তথ্য সংরক্ষিত রয়েছে সহজে প্রাপ্ত বার্ষিক প্রতিবেদনে। কিন্তু বাস্তব বড় জটিল। ফলে দেখবেন এমন কোম্পানিকে ভালো লেগে গেছে, যেটির খুব বেশিদিন হয়নি পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার। আবার কিছু সম্ভাবনাময় কোম্পানির বেশি পুরোনো বার্ষিক প্রতিবেদন খুঁজে পাবেন না আপনি। আরেকটা বিষয় হলো, একেবারে ২০-২৫ বছরের আর্থিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণপূর্বক বিনিয়োগ করতে গেলে বিশ্লেষণেই ফুরিয়ে যাবে সময় মিলবে না বিনিয়োগের অবসর। তদুপরি বহু বিনিয়োগকারী রয়েছেন, যারা পারলে কেবল কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখেই বিনিয়োগ করতেন শেয়ারে। উপরন্তু শেয়ারবাজারে (ফাইন্যান্সিয়াল সার্কেলে) মাঝেমধ্যে আর্থিক আড্ডা জমে। আর সিংহভাগ সময় তারা আলোচনা করেন চলতি বার্ষিক বা বাৎসিক প্রতিবেদন নিয়ে। সাধারণ বিনিয়োগকারীর ওপর তার প্রভাব না পড়ে পারে না। ফলে স্বল্পমেয়াদি শেয়ারপ্রতি আয় থেকে কোম্পানির সবলতা-দুর্বলতা কীভাবে বের করতে হয়, তা নিয়ে এখানে আলোচনা জরুরি মনে হয়েছে আমার। তবু আরও একবার বলছি, দীর্ঘমেয়াদি শেয়ারপ্রতি আয় দেখে কোম্পানির ভবিষ্যৎ নির্ণয় সর্বদাই সঠিক পন্থা।