পূর্বে প্রকাশের পর….
বিশ্বখ্যাত কলম্বিয়া বিজনেস স্কুলের শিক্ষক বেনজামিন গ্রাহাম সম্ভবত তার সেরা ছাত্র ওয়ারেন বাফেটের তুলনায় কম পরিচিত। তবে বাফেট বলেছেন, গ্রাহাম লিখিত ‘দ্য ইনেটেলিজেন্ট ইনভেস্টর’ বিনিয়োগের ওপর অতুলনীয় শ্রেষ্ঠ বই। আর গ্রাহাম বলেছেন, যেকোনো চমৎকার জিনিসই একই সঙ্গে প্রাপ্তির বেলায় বিরল ও বোঝার জন্য কঠিন। এ বই তার ব্যতিক্রম নয়। তবু কেন পড়বেন? জবাবটা গ্রাহামের মুখেই শুনুন কোনো বিষয়ের দাম ও মূল্য এক নয়। দাম হলো যার বিনিময়ে আপনি কিছু কিনবেন, আর তার পরিবর্তে যা মিলবে, সেটি হলো জিনিসটির মূল্য।
বিনিয়োগের পেছনে অধিক মূল্য ব্যয় করলে কমবে মুনাফা যারা বলেন, শেয়ারবাজার দীর্ঘ মেয়াদে সবসময় বন্ড বাজারকে পরাজিত করেছে ফাঁক রয়েছে তাদের দেখানো যুক্তি ও বিশ্লেষণে। ১৮৭১ সালের পূর্ববর্তী মার্কিন শেয়ারবাজারের তথ্য নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেক। তবে যেসব তথ্য রয়েছে, সেগুলোও যদি বিশ্বাসযোগ্য বলে ধরে নিই, তবু দেখা যাবে ওই সময়ে ভালো মুনাফা এসেছে মাত্র সাতটি কোম্পানি থেকে! ভাবতে পারেন, গুল মারছি। ১৮০০ সালেই মার্কিন পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ছিল কমপক্ষে ৩০০; এর মধ্যে মাত্র সাতটি কোম্পানি ভালো তা হয় কী করে? প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের যুগে আলোচিত ও আকর্ষণীয় শেয়ার ছিল টোল আদায় কেন্দ্র, খাল প্রভৃতি পরিচালনাকারী কোম্পানির। আজকের যুগের ওয়ালস্ট্রিটে গুগল, ফেসবুকের মতো তখনকার দিনে হট-কেকের মতো বিক্রি হয়ে যায় সেগুলো। কিন্তু যদি ভালোমতো খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন, ব্যাপক মুনাফা অর্জনকারী ওসব কোনো কোম্পানিরই নামগন্ধ পাওয়া যায় না ১৮৭১ সালের প্রাপ্ত তথ্যে। তার মানে, একে তো ওই কোম্পানিগুলো এ সময়ের মধ্যে দেউলিয়া হয়েছেই, উপরন্তু কোম্পানির লাল বাতি জ্বলায় মানে মানে কেটে পড়তে হয়েছে বিনিয়োগকারীদের। তাহলে ঐতিহাসিক তথ্যানুযায়ী মোটের ওপর কীভাবে অত ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়েছিল পুঁজিবাজার? এর একটা ব্যাখ্যা আছে। যে কোনো পুঁজিবাজার সাধারণত ‘সারভাইভারশিপ বায়াস’-প্রবণ। সংক্ষিপ্তভাবে এর অর্থ হলো, (অতি-দীর্ঘ মেয়াদে) শেয়ারবাজারে যে কোম্পানিগুলো ভালো করবে না, সেগুলো স্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে। কিন্তু যেগুলো টিকে যাবে, সেগুলোর পারফরম্যান্স এতটাই ভালো হয় যে, সেগুলো এককভাবেই বৃহৎ আকারে বাড়িয়ে তোলে সামগ্রিক বাজারের পারফরম্যান্স। সেজন্যই ১৮০২ সালের বহু কোম্পানির হদিস মেলে না ১৮৭১ সালে এসে। ওগুলো ততদিনে বিলুপ্ত। তখন কেবল যেগুলো বাজারের ঝড়-ঝঞ্ঝা গায়ে সইতে পেরেছে, সেগুলো দাঁড়িয়ে গেছে মহীরুহের মতো। অর্থাৎ মার্কিন পুঁজিবাজারের ঊনবিংশ শতাব্দী বিশ্লেষণে পায়ে হেঁটে বাজারে আসা বিনিয়োগকারীরা অনেকটাই অনুপস্থিত। এদের লাভ-লোকসানের খতিয়ান ইতিহাস থেকেই সম্ভবত উবে গেছে। নিশ্চিতভাবেই এসব বিনিয়োগকারীর দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা ছিল। ফলে তারা দেখতে পাননি, কেনার জন্য মাত্র সাতটি কোম্পানির শেয়ারই উপযুক্ত। তবে তাদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অসঙ্গত হবে। কেননা কয়েক শতাব্দী পরে এসে বুঝে ওঠা কঠিন, আসলে কেমন ছিল ওই সময়কার বিনিয়োগ পরিস্থিতি; তাছাড়া তখন বাজার সম্পর্কিত তথ্যেরও অবাধ যাতায়াত ছিল না। কিন্তু ওই সময়েও যাদের প্রখর ছিল দৃষ্টিশক্তি এবং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বাজারে বিনিয়োগ করেছেন, তাদের নজর এড়ায়নি যে, এই ১৭৯০’র দশক থেকে বাজারে ভালো মুনাফা দিচ্ছে ব্যাংক অব নিউইয়র্ক ও জেপি মরগ্যান চেজ। অবশ্য এ দুজন লঞ্চ দুর্ঘটনায় অলৌকিকভাবে উদ্ধার পাওয়া যাত্রী। ইতিহাসে এই নগণ্য কয়েকজনের পাশেই কিন্তু শুয়ে আছেন হাজার হাজার ধরাশায়ী বিনিয়োগকারী ও ডিসমাল সোয়াম্প ক্যানাল কোম্পানি, পেনসিলভানিয়া কালটিভেশন অব ভাইনস কোম্পানি কিংবা স্নিকারস গ্যাপ টার্নপাইক কোম্পানির মতো রাঘববোয়ালরা।
বেশকিছু গোঁজামিল আছে প্রফেসর সিগেলের উপাত্ত বিশ্লেষণে। যেমন, সিগেলের দাবি ১৮০২ থেকে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর শেয়ার বিনিয়োগে মুনাফা এসেছে ৭ শতাংশ হারে, যেখানে বন্ডে মিলতো ৪ দশমিক ৮ শতাংশ মুনাফা এবং ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাব থেকে অর্জিত হতো কমবেশি ৫ দশমিক ১ শতাংশ হারে মুনাফা। লন্ডন বিজনেস স্কুলের ইলোরি ডিমসন ও তার সহকর্মীরা প্রফেসর সিগেলের দেওয়া এই বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত নন। তাদের মতে, ওই বিশ্লেষণে প্রতি বছর অন্তত দুই শতাংশীয় পয়েন্ট (পার্সেন্টেজ পয়েন্ট) করে বেশি দেখানো হয় মুনাফা হার। ১৮৪০ সালের দিককার মার্কিন শেয়ার সূচকের বিস্তৃত তথ্য মেলে। সে সময় আলোচিত ছিল সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ২৭টি রেলওয়ের সংস্থার শেয়ার। জেসন জুইগ দেখান (এ বিষয়ে প্রথম সংস্করণেও ইঙ্গিত ছিল গ্রাহামের) ১৮৭১ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত সারভাইভারশিপ বায়াসের শিকার হয় মার্কিন শেয়ার সূচক। ওই সময়ের মধ্যে অনেকটা রাতারাতি বাজার সূচক থেকে হারিয়ে যায় কয়েকশ অটোমোবাইল, বিমান ও রেডিও কোম্পানি। জুইগের মতে, তখনকার মুনাফায়ও ১ থেকে ২ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে প্রতি বছর।
সুতরাং বাস্তবতা বলে, শেয়ারে বিনিয়োগ সবসময় বন্ড বা ব্যাংকে বিনিয়োগ অপেক্ষা ভালো নয়। কিছু ক্ষেত্রে ভালো; আবার কিছু ক্ষেত্রে খারাপ। তারপরও যদি কেউ নিঃশর্তভাবে শেয়ারকে ভালোবেসে থাকেন, তা নির্বুদ্ধিতার শামিল। আর সেটি থেকে মুক্তি পেতে কয়েকটি প্রশ্নের যৌক্তিক ও সঙ্গত প্রত্যুত্তর খুঁজে পেতেই হবে বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীকে: এক. কোন অধিকার, আইন বা ক্ষমতাবলে শেয়ারের ভবিষ্যৎ মুনাফা সবসময় অতীত মুনাফার সমান হওয়া উচিত? দুই. আপনি বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, দীর্ঘ মেয়াদে মুনাফা উপার্জনের জন্য শেয়ারবাজার একটি গ্যারান্টেড অথরিটি। এখন আপনার পাশের বিনিয়োগকারী ভদ্রলোকও যদি একই রকম ভাবতে শুরু করেন, শেয়ার কি অতিমূল্যায়িত হবে না? তিন. আর তা-ই যদি হয়, সেক্ষেত্রে আপনারা সবাই মিলে বাজারকে অতিমূল্যায়িত করবেন এবং সেখান থেকে প্রচুর মুনাফা উত্তোলনের স্বপ্ন দেখবেন, সেটি কী করে হয়?
কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে একটি বিষয় বোঝার চেষ্টা করুন। যে কোনো বিনিয়োগের মূল্য ওই বিনিয়োগের পেছনে পরিশোধিত অর্থযোগে গঠিত সমীকরণ। এর ওপর নির্ভর করে মুনাফার হার। কেউ যখনই বিনিয়োগের পেছনে অধিক মূল্য ব্যয় করবেন, তখনই কমবে মুনাফা। সহজ হিসাব। চলতি শতাব্দীর শুরুতেই মন্দার শিকার হয় ওয়ালস্ট্রিট। তার কারণ বুঝতে কয়েক বছর আগের বাজার প্রবণতার মূল্যায়ন জরুরি। ১৯৯০ দশকের শেষ দিকে মার্কিন অর্থনীতি থেকে কেটে যাচ্ছিল মূল্যস্ফীতির শঙ্কা। তখন তুলনামূলক শান্তিতে ছিল গোটা বিশ্ব। করপোরেশনগুলোর মুনাফাও হচ্ছিল দেদার। ওই সময় একদল বিনিয়োগকারী ভাবতে শুরু করেন ব্যস, মুনাফা এখন শুধু বাড়তেই থাকবে লাফিয়ে লাফিয়ে। অথচ সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান বলে, কোনো কোম্পানির পক্ষেই অসীম মুনাফা অর্জন সম্ভব নয় কখনোই। এখন আপনি যে লাভের আশায় ওই কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করছেন, তাদের লাভই যদি অসীম না হয়, আপনার মুনাফা অসীম হবে কীভাবে? আর যে শেয়ার অসীম লাভ দিতে পারে না, সে শেয়ারকে গগনচুম্বী দাম দিয়ে কিনবেন কেন আপনি? এতেও পরিষ্কার না হলে আরেকটি উদাহরণ দিই। মাইকেল জর্ডানকে ধরা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়। এই কিংবদন্তিকে এক নজর দেখতে হাজার হাজার ভক্ত উপস্থিত হতেন শিকাগো স্টেডিয়ামে। কোনো এক বছর, বাস্কেটবল ভক্তরা নেতিবাচকভাবে নেবেন না, শুধু কাঠের মেঝের ওপর চামড়ার বলকে ড্রপ খাওয়ানোর জন্য মাইকেল জর্ডানের সঙ্গে ৩৪ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে শিকাগো বুলস (বাস্কেটবল ক্লাব)। শিকাগো বুলস কি সারা জীবন ৩৪ মিলিয়ন ডলার দিতেই থাকবে মাইকেল জর্ডানকে? যদি দেয়, জর্ডানের ব্যক্তিগত মুনাফা বাড়লেও ক্লাবটির অস্তিত্ব কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?