পূর্বের প্রকাশের পর………..
১৯২০ সালের আগেই ইংল্যান্ডের সবচেয়ে দামি কোম্পানি ছিল সাউথ সি। ওই কোম্পানির কিছু শেয়ার কিনেছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা চিন্তাবিদ স্যার আইজ্যাক নিউটনও। একবার আকস্মিকভাবে দরপতন শুরু হলে তিনি বেচে দেন সাউথ সি’র সব শেয়ার। বিস্মিত নিউটন শতভাগ মুনাফায় আয় করেন সাকুল্যে সাত হাজার পাউন্ড। শেয়ারের দাম কমার পরও তার কেন লাভ হলো, এটা বুঝতে না পেরে এই মহান পদার্থবিদ নাকি তার এক বন্ধুকে বলেছিলেন ‘মহাবিশ্বের সব জাগতিক বস্তুর গতি-প্রকৃতি নির্ণয় করা সম্ভব; কিন্তু শেয়ারবাজারের মন কিছুতেই নয়।’ বিপত্তি ঘটলো এর পর। হুট করে বাড়তে শুরু করলো সাউথ সি’র শেয়ারদর। তাড়াহুড়ো করে অন্যদের দেখাদেখি বেশকিছু শেয়ার কিনে পরবর্তীতে বিক্রি করে ধরা খেলেন আনুমানিক ২০ হাজার পাউন্ড। এতে প্রচণ্ড হতাশ হন নিউটন। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত যদি ব্যর্থও হয়ে থাকেন, তার মানে এই নয় যে আপনি বোকা; আপনাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। এর কারণ হলো, সফল বিনিয়োগকারী হওয়ার জন্য যে মানসিক শৃঙ্খলার প্রয়োজন, তা আপনার নেই। যা ছিল না নিউটনেরও।
ভুলভাবে শেয়ারে বিনিয়োগের বিরুদ্ধে একপায়ে খাড়া
রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারী ও কমন স্টক
১৯৪৯ সালে যখন এ বইয়ের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়, তখন থেকে পূর্ববর্তী ২০ বছরের হিসাবে শেয়ারের বার্ষিক গড় মুনাফা ছিল ৩ দশমিক ১ শতাংশ। এর বিপরীতে একই সময়ে মোটামুটি ৩ দশমিক ৯ শতাংশ হারে গড় বার্ষিক মুনাফা মিলত দীর্ঘমেয়াদি ট্রেজারি বন্ডে। হিসাবটির ব্যাখ্যা আরও সহজে দেওয়া যায়। মনে করুন, ১৯২৯ সালে কোনো বিনিয়োগকারী ১০ হাজার ডলার বিনিয়োগ করেছিলেন শেয়ারে। সেক্ষেত্রে বাজারের গড় বার্ষিক মুনাফা আমলে নিলে তার বিনিয়োগের পরিমাণ ১৮ হাজার ৪১৫ ডলারে উপনীত হবে ১৯৪৯ সালে। একইভাবে ১০ হাজার ডলার দীর্ঘমেয়াদি বন্ডে বিনিয়োগ করলে ওই ব্যক্তি ১৯৪৯ সালে পাবেন ২১ হাজার ৪৯৪ ডলার। তবে শর্ত হলো এ সময়ের মধ্যে বিনিয়োগ করা অর্থ তোলা যাবে না বাজার থেকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ১৯৪৯ সালটি ছিল শেয়ার লেনদেনের এক দুর্দান্ত সময়। তার প্রভাব পরবর্তী এক দশকের শেয়ার পারফরম্যান্সে দৃশ্যমান। ১৯৪৯-৫৯ সাল, এই দশকে, প্রতি বছর স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর’স ৫০০ শেয়ার সূচক বৃদ্ধি পায় বার্ষিক গড় ২০ দশমিক ১ শতাংশ হারে। এই দশকে বাজার থেকে প্রাপ্ত মুনাফা মার্কিন শেয়ারবাজারের ইতিহাসে দীর্ঘতম সর্বোচ্চ মুনাফার পর্যায়কাল (পিরিয়ড)। বাজারের সেই জৌলুসভরা দিনগুলোয় শেয়ারে বিনিয়োগের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলার লোক কমই ছিল। তার পরও পাঠকের কাছে অজনপ্রিয় হয়ে ওঠার ঝুঁকিটা নিতে হয়েছে মূলত দুটো কারণে। প্রথমত, শেয়ারবাজার একটা উত্তম বিনিয়োগ ক্ষেত্র। এর অমঙ্গল কামনা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, এখানে রক্তমাংসের মানুষজন (সিংহভাগ) মাথার ঘাম পায়ে ফেলা উদ্বৃত্ত পয়সা খাটাতে আসেন দু’চার আনা মুনাফার উদ্দেশ্যে। তারা অভিশাপ দিতে দিতে বাজার ত্যাগ করুন, এও কারও কাম্য হতে পারে না। তাই প্রথম সংস্করণেই আমি জোরালোভাবে অন্তর্ভুক্ত করি, কীভাবে ও কত পরিমাণে পোর্টফোলিও’তে কমন স্টক উপাদান অন্তর্ভুক্ত করা উচিত একজন রক্ষণাত্মক বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীর।
শেয়ারবাজার সম্পর্কে বহু মানুষের ধারণা হলো, এটি ফাটকাবাজির জায়গা এবং সেহেতু অনিরাপদ। কোনো প্রসঙ্গে না জানাটাও মানবাধিকারের পর্যায়ে পড়ে। সুতরাং যারা এরূপ মনে করেন, তাদের দোষ দিই না। তবে একশ্রেণির নতুন বিনিয়োগকারীকে দেখেছি, যারা কয়েকদিন বাজারের এদিক-ওদিক ঘুরে প্রায় একই রকম ধারণা নিয়ে চলে যান। আবার বাজারে আছেন, এমন অনেক বিনিয়োগকারীও বছরের পর বছর ধরতে পারেন না বিনিয়োগ নিরাপত্তা ও বিনিয়োগ ঝুঁকি বলতে আসলে কী বোঝায়। এও বিপত্তি বটে। ওয়ালস্ট্রিট ১৯৪৬ সালে যত উঁচুতে ছিল, ১৯৭২ সালে এসে সেটি আর ওই অবস্থানে নেই। এর অর্থ কি ১৯৪৬ সালের বাজারের চেয়ে ১৯৭২ সালের বাজার খারাপ? অমনোযোগী বিনিয়োগকারী হয়তো তা-ই বলবেন। কিন্তু লক্ষ করুন, ১৯৭২ সালের পড়তি বাজারের মানে হলো ১৯৪৬ সালে যত পরিমাণ বিনিয়োগ করে আপনি যে কয়েকটি শেয়ার কিনতে পারতেন, তার অনেক বেশি পারবেন ১৯৭২ সালে।
তার মানে ঝুঁকি অনেক কম রয়েছে ১৯৭২ সালের বাজারে; তথা এখনকার শেয়ার মূল্য অতীতের তুলনায় অনেক বেশি যৌক্তিক। অথচ দেখবেন অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর ওপর ঔচিত্যের বিপরীত প্রভাব ফেলছে প্রায় প্রতিটি মন্দাবাজার। কথাটা ঘুরিয়ে বললে ইকুইটির নিরাপত্তা যখন বেশি, তখনই যেন ইকুইটির নিরাপত্তা নিয়ে বেশি শঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা। অন্যদিকে ২০ বছরের মার্কেট বুম (বাজার বিস্ফোরণ) যখন মারাত্মকভাবে ঝুঁকি বাড়িয়ে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছিল (যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে এখন), তখন কিন্তু সিংহভাগ বিনিয়োগকারী ভাবতেন বাজারে বিনিয়োগের এখনই শ্রেষ্ঠ সময়। তারা একবারও নজর দেননি, আচ্ছা, বাজারের এই অযৌক্তিক উত্থান আদৌ কোনো বৃহৎ অদৃশ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে কি না।
১৯৪৯ সালের সংস্করণে যুক্তি দেখিয়েছিলাম, মূলত দু’টি কারণে শেয়ারে বিনিয়োগ অত্যন্ত আকর্ষণীয়। প্রথমত, মূল্যস্ফীতির সে তো ক্ষয় হয় অর্থমূল্য। এটি মোকাবিলার হাতিয়ার নেই বেশিরভাগ বন্ডেরই। অথচ শেয়ারে বিনিয়োগ মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে অর্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা আবরণ। দ্বিতীয়ত, বন্ডের মুনাফা উত্থানপতনশীল। অথচ শেয়ারবাজার বিনিয়োগকারীকে বছরের পর বছর উচ্চ মুনাফা দিতে সক্ষম। ইতিহাসে ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে, যখন শেয়ারের গড় ডিভিডেন্ড আয় ছাড়িয়ে গেছে হাই-গ্রেড বন্ড থেকে প্রাপ্ত ইল্ড। তা কেন ঘটে, জানতে হলে বুঝতে হবে শেয়ারবাজারের অন্তর্নিহিত প্রকৃতি। শেয়ারবাজার বিনিয়োগের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো নয়। এখানে ঝুঁকি হাত বদল হয় লেনদেনের মাধ্যমে। বিনিয়োগকারীরাই সাধারণত এ ঝুঁকি বাড়ান। বাজার এক্ষেত্রে প্রায় শতভাগ নিরপেক্ষ। এ গেল শেয়ার বাজারের অন্যতম গাঠনিক বৈশিষ্ট্য। এর দ্বিতীয় ও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো, শেয়ারবাজারে ঝুঁকি চলমান থাকলেও এতে সর্বদা কোনো না কোনো মুনাফা থাকে স্থির তথা অবণ্টনকৃত। বাজারের এই অবণ্টনকৃত মুনাফা আসলে এক ধরনের প্রাকৃতিক প্রণোদনা। যেজন্য অবণ্টনকৃত মুনাফার অংশগুলোয় শেয়ার পুনর্বিনিয়োজিত হলে সার্বিকভাবে বাড়ে বাজারের মূল্য। তাছাড়া আরেকটি বিষয় আছে অতীতের যেসব পর্যায়কে আমরা দীর্ঘমেয়াদি অতীত বলে ধরে নিই, তার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ বলে দীর্ঘ মেয়াদে শেয়ারের রেকর্ড ভালো বন্ডের চেয়ে। ফলে শুরু থেকেই আমি শেয়ারে বিনিয়োগের ব্যাপারে যেভাবে সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলেছি, তাতে কোনো কোনো পাঠক ভুল বুঝতে পারেন আমি বুঝি শেয়ারবিরোধী আর বন্ড প্রচারক। মোটেই তা নয়। বরং আমি ভুলভাবে শেয়ারে বিনিয়োগ করার বিরুদ্ধে সর্বদা একপায়ে খাড়া। যেমন, আপনারা বিরক্ত হলেও আমি আরেকবার এখানে বলব কখনোই পোর্টফোলিও’র ২৫ থেকে ৭৫ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করবেন না শেয়ারে। বার বার এই তিক্ত উপদেশ দেওয়ার উদ্দেশ্য একটাই একটা জিনিস গড়তে যত সময় ও শ্রম লাগে, ভাঙাটা ততই সংক্ষিপ্ত ও সহজ। শেয়ারবাজারে বহু বিনিয়োগকারী পাবেন, যারা মুনাফা করেছেন দিনের পর দিন। কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে (সাধারণত অতিপ্রলোভনবশত) তাদের বিচারবুদ্ধি এতই ঘোলা হয়ে যায় যে, অত্যুচ্চ দামে শেয়ার কিনে বসে পড়ার পর আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি। আমার এই অনুধাবনের ভিত্তি ১৯২৯ সালে মার্কিন শেয়ারবাজারের মহাবিপর্যয়। ওই সময় হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর দিনের পর দিন তিল তিল করে গড়ে তোলা শেয়ার পোর্টফোলিও মাত্র একটা ভুলের কারণে বিনিয়োগকারীকে সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে কয়েক ঘণ্টা বা মিনিটে। এ তো গেল বিনিয়োগকারীদের দিক। বাজারের দিক বিবেচনায়ও শেয়ারে বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীর আধিক্য বেশি প্রয়োজন। লক্ষণীয়, নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের দু’একটা মুখ্য নীতি বা বিধি বদলিয়ে অন্যান্য বাজারের উত্থানপতন নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। কিন্তু এ নিয়মের অন্যতম ব্যতিক্রম হচ্ছে আর্থিক বাজার বিশেষত শেয়ারবাজার। বাজার একবার বিপর্যয়ের শিকার হলে নীতি পাল্টিয়ে কুল পাবেন না, অথচ বাজার আর সোজা হবে না। আসলে যেকোনো বিপর্যস্ত শেয়ার বাজারকে সুপথে ফেরাতে কিছুটা সময় প্রয়োজন। তার আগে ‘অবস্থা ভালো হচ্ছে’, ‘আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি হচ্ছে বলে মনে হলো’ করে লাভ নেই। ১৯২৯-৩২ সালের মহাবিপর্যয়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার তুলতেই লেগেছিল ২৫ বছর!
বন্ডে সুদের হারের বিপরীতে শেয়ারের ডিভিডেন্ড ইল্ডের যে প্রাধান্য ছিল, চলতি সংস্করণ লেখার (১৯৭১ সালে লেখা) সময় তা বেশ কম। এভাবে এ প্রক্রিয়ার সূচনাটা ১৯৫৭ সালে; আর সূত্রপাতকারী বিনিয়োগকারীদের অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। কোনো (শেয়ার) বাজার এহেন অযৌক্তিক আচরণ শুরু করলে সামলানোর প্রাথমিক দায়িত্বটা বর্তায় বিনিয়োগকারীদের ওপর। এর পরবর্তী কর্তব্য বাজার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের। যা হোক, আজকের এই ১৯৭১ সালের পড়তি বাজারে শেয়ার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেই তেমন উত্তেজনা। তবুও বলছি, ঝুঁকির দিক থেকে সামগ্রিক বিচারে বন্ড ও শেয়ারের মধ্যে অন্যতম পার্থক্য হলো, শেয়ার দুই শয়তানের মধ্যে ছোট শয়তান (লেসার অব টু ইভিলস)। ফলে কেবল বন্ডে বিনিয়োগ করে নিশ্চিন্ত থাকবেন না। বাজার চাঙ্গা হোক, মন্দা হোক, বিনিয়োগ করবেন শেয়ারে। সেক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক বিনিয়োগকারী হয়তো পিছপা হবেন না। কিন্তু চিন্তা রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারীকে নিয়ে। সংজ্ঞাই বলে, এক্ষেত্রে নিস্পৃহ থাকতে পারেন তিনি। তবু তাগাদা দেব, মন্দা বাজারে অবশ্যই রক্ষণাত্মক বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ করা উচিত। সেক্ষেত্রে পোর্টফোলিও’র কমন স্টক অংশকে সতর্কতার সঙ্গে বাছাই করতে হবে তাকে।