প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

বেশিরভাগ সিটি-পৌরসভা ইউনিয়ন জানে না

ট্রেড লাইসেন্সের মেয়াদ পাঁচ বছর

নজরুল ইসলাম: ট্রেড লাইসেন্স নিতে ভোগান্তির শিকার হওয়াটাই স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে! নবায়নেও ভোগান্তি পোহাতে হয়। তাও আবার মাত্র এক বছরের জন্য নবায়ন করা যায়। ব্যস্ত থাকা ব্যবসায়ীরা বিষয়টি নিয়ে খুব অসুবিধার মধ্যেই রয়েছেন। গত বছর ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণের লক্ষ্যে ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের মেয়াদ পাঁচ বছর করার দাবি জানায় মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই)। পরে উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। তারা স্থানীয় সরকার বিভাগকে লিখিত আকারে জানায়। স্থানীয় সরকার বিভাগ বিষয়টি সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদকে অবহিত করে। কিন্তু, খোদ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ও কাউন্সিলররাই জানেন না পাঁচ বছরের জন্য ট্রেড লাইসেন্স দেয়া ও নবায়ন করা যাবে। একই চিত্র পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদেও। অভিন্ন ও নির্ধারিত/সমন্বিত আবেদনপত্র, অভিন্ন ট্রেড লাইসেন্স ফরম্যাট এবং সুনির্দিষ্ট চেকলিস্টের বিষয়টিও তারা জানেন না। এছাড়া অনলাইনে ট্রেড লাইসেন্সও দেয়ার ব্যবস্থাও নেই অনেক সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে।

ব্যবসা সহজ করতে পাঁচ বছরের জন্য ট্রেড লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন এবং সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের জন্য ট্রেড লাইসেন্সের অভিন্ন ও নির্ধারিত/সমন্বিত আবেদনপত্র, অভিন্ন ট্রেড লাইসেন্স ফরম্যাট এবং সুনির্দিষ্ট চেকলিস্ট প্রণয়নের জন্য বিডার ওয়ান স্টপ সার্ভিস অ্যান্ড রেগুলেটরি রিফর্ম অধিশাখা থেকে ২০২২ সালের ১৮ জুলাই স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠি দেয়া হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগ ২০২২ সালের ১২ অক্টোবর সিটি করপোরেশন আদর্শ কর তফসিল, ২০১৬ এর বিধানের আলোকে ট্রেড লাইসেন্স ফি বছরভিত্তিক একত্রে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর মেয়াদে প্রদান বা নবায়ন করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সব সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে চিঠি পাঠায়। স্থানীয় সরকার বিভাগ গত ২৪ জানুয়ারি আরেকটি চিঠিতে সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের জন্য ট্রেড লাইসেন্সের অভিন্ন আবেদনপত্র, ট্রেড লাইসেন্স ফরম্যাট ও সুনির্দিষ্ট চেকলিস্ট প্রণয়ন করে প্রণয়ন করা আবেদনপত্র, ফরম্যাট ও চেকলিস্ট অনুসরণ করে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। কিন্তু, চিঠি চালাচালিতেই সেটি সীমাবদ্ধ রয়ে যায়।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আমানউল্যাপুর ইউনিয়নের সচিব নাজমুল হাসান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা এক বছরের জন্যই ট্রেড লাইসেন্স দিই। পাঁচ বছরের বিষয়ে কোনো চিঠি পাইনি। কিছু জানিও না।’

এই প্রসঙ্গে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (যুগ্ম সচিব) এএসএম সফিউল আজম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ট্রেড লাইসেন্স আবেদনের অভিন্ন ফরম্যাট এখনও পাইনি। মন্ত্রণালয় এখনও বুঝিয়ে দিতে পারেনি। এ-সংক্রান্ত চিঠি পেয়েছি। আমাদের এখানে এখনও অনলাইনে ট্রেড লাইসেন্স দেয়ার ব্যবস্থা নেই। অনলাইনে ট্রেড লাইসেন্স দেয়ার জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন।’

ডিএনসিসির ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আফছার উদ্দিন খান বলেন, ‘ট্রেড লাইসেন্সের বিষয়টি রাজস্ব বিভাগ দেখে। পাঁচ বছরের বিষয়টি আমি জানি না, শুনিওনি।’

উত্তর সিটির ১ নম্বর ওয়ার্ড সচিব বলেন, ‘ট্রেড লাইসেন্স বিভাগ আলাদা। প্রতি বছরই নবায়ন করতে হয়। পাঁছ বছরের বিষয়টি আমি জানি না। এটা, আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও কর কর্মকর্তা বলতে পারবেন।’

উত্তর সিটির অঞ্চল-১ এর বিবিধ আদায় শাখার কর কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ বলেন, ‘পাঁচ বছরের বিষয়টি আমি জানি না। প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা বলতে পারবেন।’

উত্তর সিটির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা (উপসচিব) আ. ন. ম. তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের চিঠি আছে। কেউ চাইলে আমরা পাঁচ বছরের জন্য দিই। না চাইলে জোর করে দিতে পারি না। পাঁচ বছরের জন্য অনেক টাকা-পয়সার বিষয় আছে তো। আমাদের ট্রেড লাইসেন্স সেবা শতভাগ অনলাইন।’

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. সফিকুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সারাদেশে অনলাইনে ট্রেড লাইসেন্স দেয়া দুটি সিটি করপোরেশনের মধ্যে কুমিল্লা একটি। গত নভেম্বর থেকে আমরা শতভাগ অনলাইনে ট্রেড লাইসেন্স দিচ্ছি। আমাদের এই সফটওয়্যারের মাধ্যমেই পাঁচ বছরের জন্যও দেয়া যাবে। কিন্তু, মানুষ নেবে কি না। যারা নিতে চাইবে, আমরা দেবো। পাঁচ বছরের বিষয়টি আমার মনে পড়ছে না। এ রকম একটি সভার রেজুলেশনের কথা জানি। চিঠির বিষয়টি ফাইলপত্র দেখে বলতে পারব।’

ডিএসসিসির ৭১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর খাইরুজ্জামান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘পাঁচ বছরের বিষয়ে আমি জানি না। এমন কোনো নির্দেশনার কথা আমার জানা নেই। এটা রাজস্ব কর্মকর্তা বলতে পারবেন। আমাদের ওয়ার্ডের ব্যবসায়ীরা অনলাইনে ট্রেড লাইসেন্স নিতে পারেন না। তারা আমার অফিসে এসে আবেদন করেন।’

ডিএসসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা (উপসচিব) আরিফুল হক বলেন, ‘আমাদের যে সফটওয়্যার আছে, সেটা পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ১ জুলাই থেকে চালু হবে। তখন থেকে পাঁচ বছর কিংবা যেভাবে চাইবে, দেয়া যাবে।’

স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্মসচিব (নগর উন্নয়ন-২ অধিশাখা) হাবিবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এখনও এই বিষয়ে কিছু জানি না। কিছু বলতেও পারছি না। যোগ দিয়েছি চার-পাঁচ দিন হবে।’

স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্মসচিব (ইউনিয়ন পরিষদ অধিশাখা) মোহাম্মদ ফজলে আজিম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘পাঁচ বছরের বিষয়টি এখনই জানবে না, এই চিঠি আজ-কালকের মধ্যে যাবে। সবগুলোতে এখনও পৌঁছেনি। সব জেলা প্রশাসনকে আমরা চিঠি দিয়েছি। সেখান থেকে ইউনিয়ন পরিষদে পাঠাবে।’

এ-সংক্রান্ত দুটি চিঠিতে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব (সিটি করপোরেশন- ১) মোহাম্মদ শামছুল ইসলামের স্বাক্ষর রয়েছে। এই বিষয়ে জানতে তার মোবাইল ফোন নম্বরে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।

স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব দেশের বাইরে থাকায় সার্বিক বিষয়ে জানতে অতিরিক্ত সচিব (নগর উন্নয়ন অনুবিভাগ) মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকীর মোবাইল ফোন নম্বরে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।

এমসিসিআই সভাপতি সাইফুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিডার নির্দেশনার চিঠি আমরা পেয়েছি। কিন্তু, সেটির প্রয়োগ এখনও শুরু হয়নি।’

সূত্রমতে, ২০২২ সালের ১১ আগস্ট রাজধানীর মতিঝিলে সংগঠনের নিজস্ব কার্যালয়ে এমসিসিআই ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণের লক্ষ্যে ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের মেয়াদ পাঁচ বছর করার দাবি জানায়। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, আমাদের ৫ কিংবা ১০ বছরের জন্য একবারে লাইসেন্স দিয়ে দেয়া কোনো সমস্যা নয়। বরং এটা আমাদের জন্য সুবিধাজনক। কারণ একবারে আমরা পাঁচ বছরের ফি পেয়ে যাচ্ছি এবং আমাদের দাপ্তরিক কাজকর্ম কমে যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো ট্রেড লাইসেন্সের ফির পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট ও এআইটি আমাদের আদায় করতে হয়। এর থেকে সিটি করপোরেশনকে যদি পরিত্রাণ দেয়া হয়, তাহলে অবশ্যই পাঁচ বছরের জন্য লাইসেন্স দেয়া যাবে।