রোহান রাজিব: বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এটির গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এছাড়া বিদেশ ভ্রমণ, বিদেশে পড়ালেখা বাবদ অর্থ প্রেরণসহ নানা কারণে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের প্রয়োজন পড়ে। আধুনিক বিশ্ব মুদ্রার বিনিময় ও লেনদেন ব্যতীত অচল। সে জন্য মুদ্রার লেনদেন সহজ করতে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠা ও ব্যাংকগুলো অনুমোদিত ডিলার শাখাগুলোকে (এডি শাখা) দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু প্রায়ই বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। তবে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় বিধিমালা না থাকায় মুদ্রার বিনিময় সংক্রান্ত অপরাধে জড়িত ব্যাংক শাখা ও মানি এক্সচেঞ্জগুলোকে শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয় না। এমন পরিস্থিতিতে অনিয়মের সাজা নিশ্চিত করতে একটি বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বিধিমালাটি জারি হলে অনিয়মের শাস্তি হবে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা। অর্থ মন্ত্রণলায়ের সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
জানা যায়, বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশে যে আইনটি রয়েছে তা হলো দি ফরেন একচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট। ১৯৪৭ সালে প্রণীত এ আইনটি বাস্তবায়নে ১৯৫২ সালে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করা হলেছিল। পরে ১৯৫৭ সালে এটি সংশোধন করে হালনাগাদ করা হয়। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ওই আইন ও বিধিমালার অনেক ধারা-উপধারা অকার্যকর হয়ে পড়ে। তাছাড়া বিগত ৫০ বছরেরও অধিক সময়ে বাস্তব পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন ব্যবস্থায়ও এসেছে অনেক পরিবর্তন। ফলে পুরোনো বিধিমালার মাধ্যমে লেনদেন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এমন বাস্তবতায় ২০১৫ সালে দি ফরেন একচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট শীর্ষক আইনটি সংশোধন করে হালনাগাদ করা হয়। আইনটিতে মোট ২৭টি ধারা রয়েছে। আইটি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য আইনের ২৭ ধারায় একটি বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু সাত বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত সেই বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়নি।
ফলে ২০১৫ সালে হালনাগাদ হওয়া ফরেন একচেঞ্জ রেগুলেশন আইন বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। আর বিধিমালা না থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনে অনিয়মকারী এডি শাখা ও মানি চেঞ্জারগুলোকেও শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে, আইনের নির্দেশনা অনুযায়ী এ সংক্রান্ত একটি বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এরই মধ্যে বিধিমালাটির খসড়া প্রণয়ন করে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিটেইনারের মাধ্যমে ভেটিং সম্পন্ন করা হয়েছে। শিগগিরই বিধিমালাটি জারি করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটি জারি হওয়ার পর কোনো ব্যাংকের এডি শাখা অথবা কোনো মানি চেঞ্জার যদি অনিয়ম করে তাহলে অপরাধের ধরন অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট শাখা বা প্রতিষ্ঠাকে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা এ বিধিমালা প্রয়োগের দায়িত্ব পালন করবে।
জানা যায়, দেশের অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কার্যকমে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকগুলোকে ফরেন কারেন্সি লেনদেনে সুযোগ দিচ্ছে। সম্প্রতি সময় এসব অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে পণ্য আমদানিতে অনিয়ম ও রপ্তানি পণ্যের মূল্য যথানিয়মে প্রত্যাবাসন হচ্ছে না। যার ফলে আমদানি ও রপ্তানির বাণিজ্যের আড়ালে দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারের ঝুঁকি বেড়েছে। যার সঙ্গে অনেক সময় দেখা যায়, সরাসরি ব্যাংকগুলো জড়িত। তাই এসব অনিয়ম রোধে আর্থিক জরিমানার আওতায় আনেত নতুন এ ধারা যুক্ত করতে যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলমান নীতিমালায়, কোনো ব্যাংকের এডি লাইসেন্স শাখা ও মানি চেঞ্জারগুলো ফরেন কারেন্সি লেনদেন ও আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে অনিয়ম করলে সর্বোচ্চ লাইসেন্স বাতিল ও আদালতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মামলা করতে পারে।
সাবেক ব্যাংকাররা বলেন, ব্যাংক ও মানিচেঞ্জারগুলো ফরেন কারেন্সি লেনদেনে অনিয়মে জড়িয়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনিটরিং করে প্রমাণ পেলেও আইনের দুর্বলতায় যথার্থ ব্যবস্থা নিতে পারে না। যদি প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়মের বিপরীতে যথার্থ দণ্ড না থাকে তাহলে যতই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নির্দেশনা দেক তারা (প্রতিষ্ঠানগুলো) তোয়াক্কা করবে না। তাই এই অর্থদণ্ডের আইনটা ভালো হবে।
সূত্র মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদিত ডিলার যদি অনুমোদনের শর্তাবলি, জারিকৃত সব আদেশ বা নির্দেশ লঙ্ঘন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শককে অসহযোগিতা, মিথ্যা তথ্য দেয়া এবং নথিপত্র ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল উপস্থান করা হয়। তাহলে এ জরিমানা করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, আর্থিক দণ্ডের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর জায়গা তৈরি করেছে। এতে সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ বৈদেশিক মুদ্রার যে সংকট তৈরি হচ্ছে তা ব্যাংক ও মানি চেঞ্জারের আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে নয়। সংকটের অন্যতম কারণ হলোÑএকচেঞ্জ রেট ফিক্স করা ও অর্থ পাচার। অর্থ পাচারের কারণে হুন্ডির চাহিদা বেড়ে গেছে। তাই আগে এসব জায়গায় হাতে দিতে হবে। আইন করে তেমন কোনো লাভ হবে না।