আল আমিন আল রাব্বি : ক্ষুধার জ্বালা বড় জ্বালা। খাদ্যাভাব এক অসহনীয় যন্ত্রণা। খাদ্যের অভাবে ধার্মিক সৃষ্টিকর্তাকে গাল দেয়, জননী প্রাণপ্রিয় সন্তানকে বিক্রি করতে বাধ্য হয়, সতী সতীত্ব বিসর্জন দেয়। খাদ্যের অভাবে যাদের দিন কাটে, তারাই বোঝেন এ অভাব কতটা কষ্টদায়ক। গরিব অসহায়দের জন্য খাদ্যাভাব সাধারণ বিষয়। তাদের এই দুর্ভোগ সহ্য করেই প্রতিনিয়ত পেটের সঙ্গে যুদ্ধ করেই দিনযাপন করতে হয়। পৃথিবী দুর্ভিক্ষের চেহারার সঙ্গে খুব ভালোভাবেই পরিচিত। ইতিহাসের দিকে তাকালে দুর্ভিক্ষের বহু চিত্রই দেখা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন করে একুশ শতকে এক আসন্ন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের বার্তা দিচ্ছে; যা গরিব অসহায়দের জন্য আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করবে এবং সাধারণ মানুষের জীবন মান আরও নি¤œমুখী করে তুলবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দুর্ভিক্ষ হচ্ছে খাদ্য সরবরাহে ঘাটতির কারণে কোনো এলাকার মানুষের অনাহারজনিত চরম দুরবস্থা। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডঋচ)-এর ভাষায় বলতে গেলে, কোনো এলাকায় যদি ২০% মানুষ কঠিন পর্যায়ের খাদ্যাভাবে ভুগে এবং ৩০% শিশু যদি তীব্র পুষ্টিহীনতায় ভুগে এবং প্রতি ১০ হাজার মানুষের মাঝে যদি ২ জন ক্ষুদা, অনাহার, রোগ এবং অপুষ্টিজনিত সমস্যায় মৃত্যুবরণ করে তাহলে তাকে দুর্ভিক্ষ বলা হয়ে থাকে। সেই হিসেবে বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৫ কোটি মানুষ চরম খাদ্যাভাবে ভুগছে, যা ২০১৯-এ ছিল প্রায় ২ কোটি ৭০ হাজার অর্থাৎ ২ বছরে তা দ্বিগুণ। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ২০২৩-এ চরম এক দুর্ভিক্ষের বার্তা দিচ্ছে; যা সারাবিশ্বের মানুষের জন্য হুমকিস্বরূপ।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বেসলে সম্প্রতি এক বক্তব্যে বিশ্বজুড়ে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এজন্য তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অস্থিরতা এবং যুদ্ধ বিগ্রহকে দায়?ী করেছেন। বলা হচ্ছে, ২০২৩ সালে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এবং এশিয়ার কিছু দেশে দুর্ভিক্ষ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
বৈশ্বিক দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে প্রথমেই সংঘাতকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো যুদ্ধে লিপ্ত থেকে অথবা খাদ্যের জন্য বিশ্বের দেশগুলো যে দেশের ওপর নির্ভরশীল থাকে সেই দেশগুলো অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা বহিরাগত পরাশক্তির সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত থাকলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। যার প্রভাব বিশ্বের অন্য দেশগুলোর ওপর পতিত হয়। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তেমন প্রভাবই বিস্তার করছে। বিশ্বের ৪০ শতাংশ খাদ্যের জোগান দেয় ইউক্রেন। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন পর্যাপ্ত গম, সানফ্লাওয়ার, শস্য এবং সার উৎপাদন করতে ব্যাহত হচ্ছে। যার কারণে পর্যাপ্ত শস্য রপ্তানি হচ্ছে না। ব্রাজিল শস্য উৎপাদনের প্রয়োজনে ইউক্রেন থেকে সার আমদানি করে থাকে। সার আমদানি করতে না পেরে ব্রাজিল যথাযথ শস্য উৎপাদন করতে সক্ষম হচ্ছে না। প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেল উৎপাদনে ও রপ্তানিকারক হিসেবে ২য় স্থানে আছে রাশিয়া, নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া ইউরোপে তেল ও গ্যাস রপ্তানি করতে পারছে না। যার প্রেক্ষিতে ইউরোপে তেল ও গ্যাস সংকট দেখা দিচ্ছে। অথচ বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ভূমিকা পালন করে জ্বলানি গ্যাস। অর্থাৎ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সারাবিশ্বের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়ছে। খাদ্যাভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কারণে অনেক দেশে মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে। অধিক মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা প্রকট হচ্ছে।
ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ জার্মানিতে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার গত মে মাসে বেড়ে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ হয়ে?ছে; যা জার্মানির গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ইউরোপের দেশ যুক্তরাজ্য গত ৪০ বছরের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতিতে পড়েছে। দেশটিতে এক বছরে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে?ছে প্রায় ৭ শতাংশ। যথাযথ আমদানি রপ্তানি করতে না পেরে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের ঘাটতি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ; যা আসন্ন দুর্ভিক্ষের জন্য তীব্র হুমকির কারণ।
জলবায়ু পরিবর্তনও আসন্ন দুর্ভিক্ষের একটা অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিভিন্ন দেশে খরা প্রখরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার কারণে আফ্রিকার অনেক দেশ খাদ্য উৎপাদনে ব্যাহত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশের অনেক দেশে আকস্মিক বন্যা দেখা দিচ্ছে। সাম্প্রতিক অস্ট্রেলিয়ায় জলবায়ুর প্রভাবে বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় যাতে তাদের প্রচুর ফসলি জমি নষ্ট হয় এবং শস্য উৎপাদন বাধাপ্রাপ্ত হয়। অধিক পরিমাণে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমনের প্রভাবে বৈশ্বিক জলবায়ু আকস্মিক পরিবর্তন হচ্ছে; যার প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপকভাবে চাপ সৃষ্টি করছে।
খাদ্যের সুসম বণ্টনের অভাবেও খাদ্যাভাব তৈরি হয়। খাদ্যের অভাবে পৃথিবীতে কখনও দুর্ভিক্ষ হয়?নি, হয়েছে সুষম বণ্টনের অভাবে। কথাটি বলেছেন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।
যার আছে সে অনায়াসে খরচ করছে আর যার নেই সে খাদ্যাভাবে ভুগছে। অধিক অপচয়ের কারণে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়াটা খুবই সাধারণ বিষয়। খাদ্যের যথাযথ ব্যবহার ও প্রয়োজন অনুসারে ভোগ করা এবং ছেড়ে দেয়া খাদ্য ঘাটতিতে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। অর্থনীতির ভাষায় ও অভাব পূরণের কাজে ব্যবহার ছাড়া অন্য কোনোভাবে দ্রব্যের উপযোগ বিনাশ করলে তা ভোগ হিসেবে নয় অপচয় হিসেবে গণ্য হবে; যা খাদ্য বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য একটা বড় কারণ।
আসন্ন বৈশ্বিক দিক চিন্তা করে আগে থেকেই এর প্রতিকারের দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন, যাতে করে খাদ্য সংকটে কাটিয়ে ওঠা যায়। উনিশ শতকে অধিক জনসংখ্যাকে ষধপশ ড়ভ ভড়ড়ফ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
কিছু সংস্থা দুর্ভিক্ষ রোধে কিছু পদক্ষেপের দিকে নজর দিয়েছে। যেগুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারলে দুর্ভিক্ষ রোধে কিছুটা প্রতিকার হবে। পরিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, যাতে করে পানিবাহিত রোগ কম ছড়ায়। কারণ খাদ্যাভাবে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, সুতরাং বিশুদ্ধ পানির অভাবে বিভিন্ন রকমের পানিবাহিত রোগ ছড়াতে পারে, যা দুর্ভিক্ষকে আরও প্রকাণ্ড আকারে নিয়ে যাবে। মানুষকে যথাযথ সেনিটেশনের তাগিদ দেয়া। খাদ্যের সুষম বণ্টন। সরকারের সঠিক খাদ্য বণ্টনের দিকে নজর দেয়া। বেশি পরিমাণে শস্য উৎপাদনে মনোযোগী হওয়া, যা আমদানি চাহিদার প্রতি নির্ভরশীলতা কমাবে। খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে খাদ্য উৎপাদনে মনোযোগী হলে খাদ্যাভাবে খাদ্য চাহিদা দমন করা যাবে। সরকারের যথাযথ জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং যথাযথ যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ যাতে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি যথাযথভবে খাদ্য পৌঁছাতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশ সরকার কিছুদিন ধরে আসন্ন দুর্ভিক্ষে মানুষকে প্রস্তুত থাকতে বলছে এবং যথাযথ ব্যবস্থাপনার জন্য তারা প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। দুর্ভিক্ষ রোধে সরকারি ব্যবস্থাপনা ও জনগণের প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। পর্যাপ্ত কৃষিপণ্য উৎপাদন করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাস ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় কৃষিই অন্যতম প্রধান নিয়ামক। কৃষি জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহ, কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের কাঁচামাল সরবরাহের নিশ্চয়তা দেয়।’ আন্তর্জাতিক বিশ্বে পণ্যের অতিরিক্ত দামের প্রভাবে সঠিকভাবে পণ্য আমদানি করতে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। সুতরাং আমদানি ব্যয় কমাতে পারলে এবং কৃষি খাতে পর্যাপ্ত অর্থ প্রদান ও কৃষি সংস্থাগুলোর যথাযথ কৃষি উৎপাদনে তাগিদ মানুষকে পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদনে সহযোগিতা করবে। এতে করে দেশীয় খাদ্যাভাব মিটবে এবং দুর্ভিক্ষের প্রভাব কিছুটা হলেও রোধ কর যাবে।
দ্বিতীয়ত, সরকারের যথাযথ খাদ্যের সঠিক বণ্টনের দিকে নজর দেয়া উচিত এবং জনগণের কথা মাথায় রেখে গণতান্ত্রিক চিন্তায় এই ঝড়কে প্রতিহত করা উচিত। অমর্ত্য সেনের একটা বাণী না বললেই নয় ‘স্বাধীন গণমাধ্যম এবং গণতান্ত্রিক দেশে কখনও দুর্ভিক্ষ হয় না।’ সুতরাং পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক গবেষণা, পর্যালোচনা, গণমানুষের অধিকারের দিকে সঠিকভাবে নজর দিলে এই দুর্ভিক্ষ রোধ করা সম্ভব।
সুতরাং বাংলাদেশের মানুষের শস্য উৎপাদনে আগ্রহ বৃদ্ধিকরণ ও সরকারের যথাযথ পর্যালোচনা ও সঠিক পদক্ষেপের দ্বারাই আসন্ন দুর্ভিক্ষ রোধ করা সম্ভব।
শিক্ষার্থী, আরবি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়