প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

ব্যাংকে টাকার পাহাড়, সরকারের ঋণ শোধ করছে না বিপিসি!

ইসমাইল আলী: আন্তর্জাতিক বাজারে লম্বা সময় ধরে নিন্মমুখী ছিল জ্বালানি তেলের দাম। এতে ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে টানা সাত বছরে উচ্চ হারে মুনাফা করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। যদিও বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকায় গত অর্থবছর লোকসান গুনেছে সংস্থাটি। তবে এখনও দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে বিপিসির প্রচুর অর্থ জমা রয়েছে। এমনকি সংস্থাটির মোটা অঙ্কের রিটেইন্ড আর্নিংসও (অবণ্টিত মুনাফা) রয়েছে। এরপরও সরকারের ঋণ পরিশোধ করছে না বিপিসি।

বিভিন্ন সময় লোকসানের ঘাটতি পূরণে বিপিসিকে এ ঋণ দিয়েছিল সরকার। তবে মুনাফায় ফেরার পরও সে ঋণ পরিশোধ করেনি সংস্থাটি। উল্টো ওই ঋণকে ভর্তুকিতে রূপান্তরের জন্য কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে দেশে জ্বালানি তেলের একমাত্র আমদানিকারক ও বিপণনকারী সংস্থাটি।

সম্প্রতি প্রকাশিত বিপিসির সর্বশেষ (২০২১-২২ অর্থবছর) নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, বর্তমানে সরকারের কাছে বিপিসির ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৮ হাজার ৮৫৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এর মধ্যে লোকসানের বিপরীতে সংস্থাটিকে ঋণ দেয়া হয়েছে ২৭ হাজার ৪১৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা। ২০০৫-০৬ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত এ ঋণ দেয়া হয়েছে।

যদিও ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে পরবর্তী সাত বছরে বিপিসি মুনাফা করেছে প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা। তবে গত অর্থবছর বিপিসি আবার লোকসান গুনেছে প্রায় দুই হাজার ৭০৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও বিপিসির তথ্যমতে, ২০০৫-০৬ অর্থবছর বিপিসির লোকসান ছিল দুই হাজার ৩১৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, ২০০৬-০৭ অর্থবছর তিন হাজার ৩৩৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ও ২০০৭-০৮ অর্থবছর ৯ হাজার ৫৫৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। তবে ২০০৮-০৯ অর্থবছর বিপিসি মুনাফা করে। ওই অর্থবছর সংস্থাটির মুনাফার পরিমাণ ছিল ৩২২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।

এর পর থেকে আবারও টানা লোকসান শুরু করে বিপিসি। এর মধ্যে ২০০৯-১০ অর্থবছর লোকসান গুনে দুই হাজার ৪৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, ২০১০-১১ অর্থবছর আট হাজার ৮৪০ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছর ১১ হাজার ৩৭১ কোটি ৩১ লাখ টাকা, ২০১২-১৩ চার হাজার ৮৩২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছর দুই হাজার ২৩১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।

সূত্র জানায়, লোকসানের ঘাটতি মোকাবিলায় বিপিসিকে সরাসরি ভর্তুকি না দিয়ে ঋণ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে মুনাফা ফেরার পর আর ওই ঋণ শোধ করেনি বিপিসি। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছর বিপিসি মুনাফা করে চার হাজার ২১২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছর ছয় হাজার ৬৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছর আট হাজার ৪৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছর ছয় হাজার ৫৩৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছর তিন হাজার ৯৮০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছর পাঁচ হাজার ৬৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছর ৯ হাজার ৯২ কোটি ৬১ লাখ টাকা।

মোটা অঙ্কের মুনাফা করলেও সব বছর সরকারি কোষাগারে লভ্যাংশও জমা দেয়নি বিপিসি। এর মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছর এক হাজার কোটি টাকা ও ২০১৬-১৭ অর্থবছর এক হাজার ২০০ কোটি টাকা লভ্যাংশ সরকারি কোষাগারে জমা দেয় সংস্থাটি। আর ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছর ৩০০ কোটি টাকা করে ৯০০ কোটি টাকা সরকারের তহবিলে জমা দিয়েছে সংস্থাটি।

যদিও বিভিন্ন ব্যাংকে বিপিসির বড় ধরনের আমানত জমা রয়েছে। গত জুন শেষে জমার

 পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ৪৬২ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংক ও এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ১১ হাজার ১২৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা দীর্ঘমেয়াদি আমানত জমা রেখেছে বিপিসি। বেসরকারি ১৩টি ব্যাংকে স্বল্পমেয়াদি আমানত হিসেবে জমা রাখা হয়েছে এক হাজার ৮৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। আর জ্বালানি তেল বিক্রি বাবদ গত অর্থবছর জুন শেষে সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি ৩২টি ব্যাংকে বিপিসির নগদ জমা ছিল ১৪ হাজার ৫০৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।

এদিকে গত অর্থবছর শেষে বিপিসির অবণ্টিত মুনাফা দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৭০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এ সময় সংস্থাটির ইক্যুইটির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৬৬১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এরপরও সরকারের ঋণ পরিশোধ করছে না বিপিসি।

জানতে চাইলে বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় প্রায় এক বছর পর্যন্ত বিপিসির নিজস্ব তহবিলের টাকায় ভর্তুকি দিয়ে তেল বিক্রি করা হয়। এতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিতে হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কমেছে, তবে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে তেল আমদানিতে খরচ বেশি পড়ছে। এতে বিপিসি এখনও লোকসানের মধ্যেই আছে। তবে জ্বালানি তেলের দাম কমায় বিপিসির লোকসানের মাত্রা কিছুটা কমে এসেছে, কিন্তু এখনও লোকসানমুক্ত হতে পারেনি। এ কারণে আগের দেয়া ঋণকে ভর্তুকিতে রূপান্তরের চেষ্টা চলছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। তবে এখনও তা অনুমোদন করেনি সরকার।