জাহিরুল ইসলাম: প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে ব্যাংক হিসাবে আরোপিত বাড়তি আবগারি শুল্ক যে গ্রাহকদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে, তাতে সন্দেহ নেই। এটা বোঝা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক ফোরামের আলোচনা থেকে। হিসাব-নিকাশ করে এরই মধ্যে অনেকে বের করেছেন, ব্যাংকগুলো এখন যে হারে মুনাফা দিচ্ছে, তাতে স্কিমের মেয়াদ শেষে লাভ তো পাওয়া যাবেই নাÑউপরন্তু পুঁজি থেকে টাকা গচ্ছা দিতে হতে পারে। আবগারি শুল্ক বৃদ্ধির কারণে কোনো স্কিমে আমানতকারীকে মূলধন থেকে কত টাকা গচ্ছা দিতে হবেÑবাজেট ঘোষণার পর এমন অনেক হিসাব চোখে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বাস্তবতা হলো, এ ধরনের যেসব হিসাব যোগাযোগ ও সংবাদমাধ্যমে চোখে পড়েছে, সবই প্রথম তিন মাসের হিসাব। এরপর যে চিত্র কিছুটা পাল্টে যাবে, সেটা এসব আলোচনায় তেমন উঠে আসেনি।
বাজেট ঘোষণার পর অনেক ফোন পেয়েছি পরিচিতদের থেকে। তারা বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন। অফিসের একটা উল্লেখযোগ্য সময় অতিবাহিত হয়েছে গ্রাহকদের আবগারি শুল্ক-সংক্রান্ত হিসাব বোঝাতে। তাতে দুটি বিষয় দৃষ্টিগোচর হলো, এটা যে আগে থেকেই ছিল, তা অনেকে জানতেন না। সর্বোচ্চ স্থিতির ওপর বছরে একবার আবগারি শুল্ক কর্তন কীভাবে করা হবে, সে হিসাবও অনেকের কাছে অস্পষ্ট। তাতে লক্ষ করলাম, এ নিয়ে একধরনের ভীতির মধ্যে রয়েছে মানুষ। দুর্ভাবনায় পড়ে অনেকে যে এরই মধ্যে ব্যাংক থেকে পুঁজি প্রত্যাহার শুরু করেছেন, তা বলা বাহুল্য। কিন্তু এটা হয়তো অনেকের কাছে অস্পষ্ট যে, ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিলেও এ শুল্ক থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ খুব কম। কারণ ইলেকট্রনিক ইন্টিগ্রেটেড ব্যাংকিং সিস্টেমের (ইআইবিএস) সফটওয়্যারে এমনভাবে ইনপুট দেওয়া থাকে যে, অ্যাকাউন্টে লেনদেন হওয়ার সঙ্গেই প্রযোজ্য হারে আবগারি শুল্ক ধরে রাখা হয়। লেনদেন যে সময়েই হোক, তা ধরে রাখা হয় সংশ্লিষ্ট ইংরেজি পঞ্জিকাবর্ষের জন্য গ্রাহকের হিসাব থেকে এ শুল্ক সমন্বয় না করা পর্যন্ত। তাই এ টাকা উত্তোলনের সুযোগ গ্রাহকের থাকে না। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, আবগারি শুল্ক বাড়ানোর বিষয়টি এ কয়েক দিন সংবাদমাধ্যমে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার হয়েছে, আগে এক লাখের নিচে ২০ হাজার টাকার যে স্তর ছিলÑসেটা যে তুলে দেওয়া হয়েছে, প্রচারণায় এটাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তাহলে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ কিছুটা হলেও কমতো মনে হয়।
বর্ধিত আবগারি শুল্ক নিয়ে এর মধ্যে সংসদেও আলোচনা হয়েছে। তাতে সরকারদলীয় বেশ কয়েকজন সদস্য এটা প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছেন। এর মধ্যে আনোয়ারুল আবেদিনের মন্তব্যটি উল্লেখ করার মতো। তিনি বলেছেন, সামান্য লাভের জন্য মানুষকে ব্যাংকবিমুখ করা ঠিক হবে না। বস্তুত আসন্ন বাজেটে আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাবের পর এ আলোচনাটিই হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে জনমনে যে ভীতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ব্যাংক খাতে মানুষকে কি ধরে রাখা যাবে?
প্রশ্নটি উঠেছে আরও একটি কারণে। ব্যাংক খাতে আমানতের মুনাফার হার এখন নি¤œমুখী। কয়েক দিন আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বরাত দিয়ে শেয়ার বিজের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এ বছর এপ্রিলের শেষে আমানতে গড় মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ। মুনাফার হার ক্রমাগতভাবে নি¤œমুখী হওয়ায় গ্রাহকরা এমনিতেই কিছুটা নাখোশ। আগেও অনেককে দেখা গেছে ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনতে। কিন্তু এবার সেটা হবে বলে মনে হয় না। কারণ অর্থমন্ত্রী এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, সঞ্চয়পত্রেও কমানো হবে মুনাফার হার। এতে সরকারের ব্যয় কমানোর যুক্তির পাশাপাশি রয়েছে আর্থিক খাতে ভারসাম্য সৃষ্টির চিন্তা।
আয় বৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের ভোগব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতা যেমন বাড়ে, একইভাবে বেড়ে ওঠে পুঁজি বিনিয়োগ করে আয় পুনর্বৃদ্ধির চেষ্টা। আমাদের প্রবৃদ্ধিতে অবশ্য ভোগব্যয়ের অবদান ব্যক্তি বিনিয়োগের তুলনায় বেশি। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতের এ চিত্রের কারণে ব্যক্তি বিনিয়োগ আরও কমতে পারে। এতে প্রবৃদ্ধিতে এ খাতের অবদান আরও কমে এলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কেউ হয়তো বলতে পারেন, তাতে বেড়ে উঠবে ভোগব্যয়। এটা প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের গতিকে করবে ত্বরান্বিত। প্রশ্ন হলো, উন্নয়নের যে স্তরে আমরা রয়েছিÑএ স্তরে ভোগব্যয় বেড়ে ওঠা অর্থনীতির জন্য কি মঙ্গলজনক হবে? ফেব্রুয়ারিতে আমানত ও বিনিয়োগের মুনাফায় ভারসাম্য রক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যে সার্কুলার জারি করা হয়েছিল, তাতে একে দেখা হয়েছে শঙ্কার দৃষ্টিতে।
অনেকে মনে করেন, এর মাধ্যমে ব্যাংক খাতে বিদ্যমান অলস টাকাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তারল্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে খাতটিতে ভারসাম্য সৃষ্টি হলে আমানতের মুনাফায় ইতিবাচক ধারায় ফেরা সম্ভব বলে তাদের অভিমত। এ কথায় যুক্তি কিছুটা হয়তো রয়েছে। তাতেও প্রশ্ন থেকে যায়। ব্যাংক খাতে অলস টাকা কমে গেলে বিনিয়োগের মুনাফাও কি একইভাবে বাড়বে না? বর্তমানে এক্ষেত্রে যে রেট রয়েছে, তাতেই ‘ভালো’ বিনিয়োগ গ্রাহক পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে ব্যাংকগুলোর জন্য। বর্ধিত রেটে বিনিয়োগ নেওয়ার জন্য ব্যাংক খাতে আকৃষ্ট হবেন এটা মনে করা সংগত বলে মনে হয় না।
ব্যাংক খাতের এ পরিস্থিতিতে সঞ্চিত আমানত মানুষ তাহলে রাখবে কোথায়? শেয়ার বিজের প্রতিবেদনে লক্ষ করলাম, একজন বিশ্লেষক বলেছেনÑমানুষ টাকা নিজের হাতে রাখবে না। তারা খুঁজবে বিনিয়োগের অন্য কোনো ক্ষেত্র। এমন পরিস্থিতিতে বিকল্প হিসেবে তারা চলে আসবে শেয়ারবাজারে। এখানে যখন বেশি টাকা আসবে, তখন বাজার চাঙা হওয়ার সুযোগ থাকবে। যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করলে তার মন্তব্যের সঙ্গে একমত হওয়ার সংগত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ ব্যাংক খাতে আমানত যেমন নিরাপদ এবং মুনাফা যেমন নিশ্চিত, শেয়ারবাজারে কিন্তু সে রকম নয়। আর আমাদের শেয়ারবাজার যত দ্রুত ওঠানামা করে এবং নিকট অতীতে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার যে নজির সৃষ্টি হয়েছে, সে ব্যাপারেও মানুষের আতঙ্ক কাটেনি। এটা কাটানোর পাশাপাশি বাজারকে আরও সংহত করা গেলে বর্তমান বাস্তবতায় মানুষ এ বিকল্প ক্ষেত্রে আসার বিষয়টি চিন্তা করতে পারতো।
আরেকটি কারণ হলো, শেয়ারবাজার যে বিনিয়োগের একটি ক্ষেত্র এবং এখানে বিনিয়োগ করে মুনাফা পাওয়া যায়Ñদেশের অনেক মানুষের তা অজানা। এখানে বিনিয়োগের জন্য ন্যূনতম যে ধারণা প্রয়োজন, সেটাও অনেকের নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাত দিয়ে কয়েক দিন আগে সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখেছি, আমানত ও ঋণগ্রহীতা মিলে দেশের ব্যাংক খাতে হিসাব এখন প্রায় ৯ কোটি। এর মধ্যে অনেকে রয়েছেন, যাদের হিসাব রয়েছে একাধিক ব্যাংকে। একই ব্যাংকে একাধিক হিসাব পরিচালনাকারী ব্যক্তিও অনেক। সব মিলিয়ে প্রকৃত হিসাবধারী অর্ধেক বিবেচনা করলেও সংখ্যাটি দাঁড়ায় সাড়ে ৪ কোটি। মনে রাখতে হবে, আমাদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী মাত্র ৩০ লাখ। অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন বিপুল মানুষ যে এ বাজারে বিনিয়োগের ব্যাপারে এখনও ওয়াকিবহাল নন, আনুমানিক এ পরিসংখ্যান থেকেই তা স্পষ্ট। আর ব্যাংক খাতের উদ্ভূত বাস্তবতায় এ ব্যাপারে হঠাৎ করে তাদের মধ্যে জানাবোঝা তৈরি হবে কিংবা নিজ উদ্যোগে বিনিয়োগের এ বিকল্প ক্ষেত্রের প্রতি তারা উৎসাহী হবেনÑসেটা ভাবাও সংগত নয়।
যে কোনো ধরনের বিনিয়োগেই ঝুঁকি থাকে। তা সত্ত্বেও মানুষ এটি করে থাকে ‘ভালো’ রিটার্নের প্রত্যাশায়। এজন্য ঝুঁকি যথাসম্ভব কমানোর প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায় তার মধ্যে। একইভাবে বাড়তি লাভের প্রত্যাশাও বিনিয়োগকারীর স্বাভাবিক প্রবণতা। দেশের বর্তমান বাস্তবতায় ব্যাংক খাতে বিরাজ করছে ভীতি; শেয়ারবাজারে অনিশ্চয়তা। সঞ্চয়পত্র নিয়ে মানুষের মধ্যে যে উৎসাহ ছিল, তাতেও কিছুটা ভাটা পড়েছে এর মুনাফা কমানোর ব্যাপারে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োজিত করতে যে নতুন ক্ষেত্র সন্ধান করবে, তাতে সন্দেহ নেই।
গ্রামগঞ্জে যেসব এনজিও বা কো-অপারেটিভ সোসাইটি কাজ করে, জনসাধারণের কাছ থেকে তারাও গ্রহণ করে আমানত। তারা যে মুনাফা দেয়, সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যাংক কিংবা সঞ্চয়পত্রের মুনাফার চেয়ে বেশি। এখানে আমানতের নিরাপত্তা অপেক্ষাকৃত কম হলেও মুনাফার হার বেশি হওয়ায় মানুষ ঝুঁকি নেয় সহজে। প্রতিদিন যেসব গ্রাহক পরামর্শ নিতে আসেন, গত কয়েক দিনে তাদের বেশ কয়েকজনের কাছে এ প্রশ্নেরও মুখোমুখি হয়েছিÑব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে ওইসব স্থানে রাখা ঠিক হবে কি না? বলা ভুল হবে না, ব্যক্তিগত বা পারিবারিক প্রয়োজনে যাদের সঞ্চিত আমানতের মুনাফার ওপর নির্ভর করতে হয়, তাদের অনেকেই এখন ভাববেন এভাবে। মহাজনি সুদ প্রথা এখনও চালু রয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। একটি অঞ্চলের কিছু ব্যবসায়ীকে দেখেছি, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেটা তারা সুদে খাটান আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বাইরে থাকা মানুষের মধ্যে; অপেক্ষাকৃত উচ্চ সুদে। ব্যাংক খাতের বিদ্যমান করভীতি ও মুনাফার ক্ষেত্রে হতাশাজনক পরিস্থিতিতে সুদে টাকা খাটানোর প্রবণতা যদি বেড়ে ওঠে, তাতে অবাক হবো না।
সংসদ সদস্যদের সমালোচনার জবাবে অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, ব্যাংক হিসাবের সর্বোচ্চ স্থিতি অনুযায়ী আবগারি শুল্ক নতুনভাবে আরোপ করা হয়নি, বরং কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই আহরণ করা হচ্ছে এ কর। অতএব প্রস্তাব পুনর্বিবেচনা করা হবে না। এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লক্ষ করলাম, সরকার গ্রাহকের মূল টাকায় কেন আবগারি শুল্ক আরোপ করবে, তাতে তোলা হয়েছে এ প্রশ্ন। এ ইস্যুতে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কথাও ভাবছেন কেউ কেউ। বিশ্বের কোনো দেশেই নাকি এমন নিয়ম নেইÑএ তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সাবেক পদস্থ কর্তা। সব মিলিয়ে বলা যায়, বাজেট পাস না হওয়া পর্যন্ত এ নিয়ে আলোচনা চলতেই থাকবে। আর সত্যিই কেউ যদি আদালতের দ্বারস্থ হন, তাহলে ইস্যুর নিষ্পত্তিটা হবে আরও দীর্ঘায়িত। ব্যাংক খাতে এর প্রভাব কতটা পড়লো, সেটা অবশ্য জানা যাবে জুনের হিসাব সমাপনী শেষে। মানুষ শেয়ারবাজারমুখী হলে সে হিসাব পেতেও বেগ পেতে হবে না ওই সময়ে।
বহুল প্রচারিত এক দৈনিকের প্রতিবেদনে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, বাড়তি আবগারি শুল্ক কার্যকর করা হলে সরকারের আয় বাড়বে ৩৫৬ কোটি টাকা। সরকার চাইলে সমপরিমাণ কর অন্য খাত থেকে আহরণ করা কঠিন নয়। মনে রাখতে হবে, এ শুল্ক নিয়ে সমালোচনা যেভাবে শুরু হয়েছে, তাতে স্বল্প মেয়াদে ব্যাংক খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব তো পড়বেইÑবিনিয়োগও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দেশের আর্থিক খাতে বেশ কিছুদিন ধরে যে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে, তাতে নতুন মাত্রা যোগ করা সুবিবেচনাপ্রসূত হবে না। ব্যাংক খাতের এমন পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারে ‘পৌষ মাস’ আসবে বলে যারা মনে করছেন, তাদের এ বাজারের বাস্তবতা ও সংগত যুক্তিগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে।
লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা
zahirul.duÑgmail.com