রোহান রাজিব: নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ছাড় দিয়েও কমানো যাচ্ছে না খেলাপি ঋণ। আর খেলাপি ঋণ বাড়ার ফলে বেহাল দশায় পড়েছে দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই)। চলতি বছরের সেপ্টেম্বের শেষে এ খাতে মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৩২৭ কোটি ১০ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে দুর্ভোগে পড়েছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এছাড়া কভিডের কারণে গত দুই বছর গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধে নানা সুবিধা পেয়েছে। চলতি বছরে নতুন করে তাদের আবারও সুবিধা দেয়া হয়েছে। এর ফলে এসব প্রতিষ্ঠান ভাবছে, ঋণ পরিশোধ না করলেও চলবে। তাই ব্যাংক খাতের মতো এ সেক্টরেও খেলাপি ঋণ দিন দিন বেড়েই চলছে। এখনই উচিত হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর হওয়া। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর না হলে এ খাতের খেলাপি ঋণ দিন দিন আরও বাড়তে থাকবে। আর নতুন নতুন ছাড় দেয়ার সিস্টেমও বন্ধ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এনবিএফআইগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণ দাঁড়ায় ৭০ হাজার ৪১৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৩২৭ কোটি ১০ লাখ, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৪.৬১ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১৩ হাজার ১৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯ মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ঋণ চার হাজার ৩১১ কোটি টাকা।
এছাড়া ২০২২ সালের জুন শেষে এনবিএফআইগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণ ছিল ৬৯ হাজার ৩৩১ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার ৯৩৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ২৩ শতাংশ। সে হিসেবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ এক হাজার ৩৯০ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বেড়েছে।
অন্যদিকে চলতি বছরের মার্চ শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ২৩২ কোটি ৮ লাখ টাকা। সে হিসেবে ছয় মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিন হাজার ৯৪ কোটি তিন লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) সময়ে খেলাপি ছিল ১০ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা। তিন মাস পর জুন প্রান্তিক শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ২৫ কোটি টাকা কমে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। আর (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৪২৯ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণ আগের প্রান্তিকের তুলনায় এক হাজার ২৫৯ কোটি টাকা বেড়ে হয় ১৩ হাজার ১৬ কোটি টাকা।
বর্তমানে দেশে আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৫টি। এর মধ্যে দুটি সরকারি, ১৯টি বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের ও ১৩টি দেশি-বিদেশি যৌথ বিনিয়োগের। অন্যটি একটি সরকারি ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান।
এদিকে আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৯৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি ১১ লাখ টাকা খেলাপি হয়ে পড়ছে, যা ব্যাংক খাতের মোট বিতরণকৃত ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত জুন শেষে ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। ওই সময়ে বিতরণকৃত মোট ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ ছিল খেলাপি। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ৯ হাজার ১৩৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে খেলাপি ঋণ। আর গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ তিন হাজার ২৭৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। সে অনুযায়ী ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) খেলাপি বেড়েছে ৩১ হাজার ১২৩ কোটি টাকা। ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হারের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, খেলাপি ঋণ বাড়াতে উৎসাহিত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব নীতিমালা করেছে তাতে ঋণখেলাপিরা অনেক ছাড় পেয়েছে। তার মনে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সুবিধা দিচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার ফলে ভালো গ্রাহকরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। তারাও ভাবছে ঋণ পরিশোধ না করলেও চলবে। তাই এখন ভালো গ্রাহকরাও খেলাপি হয়ে পড়ছেন।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলোকে যেভাবে নজরদারি করা হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে, সেভাবে নজরদারি করা হয়নি। সেই সুযোগে জনগণের টাকা নিয়ে তা আত্মসাৎ করায় বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। সঠিক সুপারভিশন করা হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের বোঝা কমানো সম্ভব হতো। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হবে, এখনই এ সেক্টরকে নজরদারি করা।