শামসুন নাহার: একদিকে বাড়ছে প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল; অন্যদিকে বিভিন্ন কারণে কমছে জন্মহার। জন্ম ও মৃত্যুহারের সামঞ্জস্য না থাকায় বাড়ছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা। ফলে অবসরপ্রাপ্ত ও উপার্জনহীন জনগোষ্ঠী দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু তাদের জন্য সৃষ্টি হচ্ছে না পর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম। অনেকেই থেকে যাচ্ছেন বয়স্ক ভাতা বা পেনশন স্কিমের আওতার বাইরে। ধীরে ধীরে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী অনুৎপাদনশীল ও সম্পূর্ণ অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে এশিয়ার দেশগুলোয়। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দশকগুলোতে উপার্জনে অসমর্থ বয়স্ক মানুষের সংখ্যা আরও দ্রুত বাড়বে। অথচ দেশগুলোর সরকারের এ বাস্তবতা মোকাবিলায় কোনো প্রস্তুতি নেই। ফলে দেশগুলোর ওপর ক্রমবর্ধমান এ প্রবীণ জনসংখ্যার সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে গড় আয়ুষ্কাল পুরুষদের ৭৫ ও নারীদের ৭৯ বছর। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন, চলতি শতকের মাঝামাঝি নাগাদ এশিয়ার বয়স্ক জনগোষ্ঠী হবে প্রায় ৯২ কোটি ৩০ লাখ। ফলে এ মহাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক জনবহুল অঞ্চল হতে চলেছে। একমাত্র চীনেই মোট প্রবীণ সংখ্যা ২০ কোটি, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সব দেশের মোট প্রবীণ জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। দ্রুত প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির চিত্রটি আরও স্পষ্ট বোঝা যায় মালয়েশিয়ার জনমিতি লক্ষ করলে। দেশটিতে ২০১০ সালে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ছিল ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০৫০ সাল নাগাদ এ হার তিনগুণ বেড়ে হবে প্রায় ১৫ শতাংশ। মোট বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধি বাদেও কম সময়ে বৃদ্ধ হয়ে যাওয়াটাও এ অঞ্চলের মানুষের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। ভিয়েতনামে ৪০ বছর-পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যেই একজন মধ্যবয়সী ব্যক্তি বয়স্ক বা প্রবীণ হিসেবে বিবেচিত হন। থাইল্যান্ড ও জাপানে মধ্যবয়সী ও প্রবীণ ব্যক্তির বয়সের পার্থক্য যথাক্রমে ২২ ও ২৬ বছর। বাংলাদেশেও চিত্রটি বেশ আশঙ্কাজনক। প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল বাড়লেও সুস্থতা বাড়েনি। সচেতনতার অভাব ও খাদ্যাভ্যাসের কারণেও এদেশের মানুষের জীবনীশক্তি দ্রুত কমে আসে। তাই ৫০-৫৫ বছরের মধ্যেই বিভিন্ন বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে বিপুলসংখ্যক মানুষ।
সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দ্রুত পরিবর্তনশীল জনমিতি, বিশেষত জš§হার হ্রাস ও আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পাওয়া এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতির গতিপথ পুনর্নির্ধারণ করে দেবে। যে বর্ধিত জনসংখ্যা এশিয়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এনে দিয়েছে, তা-ই এখন এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে বিপরীত দিকে ঠেলে দিতে পারে। এডিবির উপ-প্রধান অর্থনীতিবিদ জুঝং জুয়াং মনে করেন, যেহেতু বর্ধিত জনসংখ্যাই এশিয়ার প্রবৃদ্ধিকে বেগবান করেছে, তাই এ অঞ্চলের সরকারগুলোর উচিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বজায় রাখার নতুন নতুন উপায় খুঁজে বের করা এবং বর্ধিত প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে সহায়তা জোগানো।
চীনের বয়স্ক জনগোষ্ঠীর অর্ধেক গ্রামে বাস করেন এবং তাদের মধ্যে কেবল ১০ শতাংশ গ্রামীণ পেনশন স্কিমের আওতায় রয়েছেন। ভারতে সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ কর্মী পেনশন সুবিধা ভোগ করেন। বাংলাদেশে এ অবস্থা আরও করুণ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল ৭১ বছর। আর প্রতি হাজারে মৃত্যুহার ৫ দশমিক ৬৬ ও জš§হার ১৯ জন। এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো এদেশেও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও গণসচেতনতার মাধ্যমে গত কয়েক দশকে জš§হার ক্রমাগত কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া চিকিৎসাসেবা ও আধুনিক প্রযুক্তির প্রসারের ফলে গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়ায় মৃত্যুহারও কমে এসেছে। ফলে এদেশেও বিপুলসংখ্যক বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক রয়েছেন। অথচ এর মধ্যে একটি নগণ্য অংশ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রমের আওতায় পরিচালিত বিভিন্ন ধরনের পেনশন সুবিধা পান। দেশের প্রায় অর্ধেক শ্রমশক্তি এখনও কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আর তাদের বাস গ্রামে। গ্রামে বসবাসরত দরিদ্র বয়স্ক মানুষের জন্য মাসিক মাত্র ৪০০ টাকা হারে ভাতা দেওয়া হলেও কেবল ৩০ লাখ বয়স্ক মানুষ এ সুবিধা পান।
অন্যদিকে বেসরকারি খাতে কর্মরত অধিকাংশ শ্রমিক চাকরি-পরবর্তী কোনো আর্থিক সহায়তা পান না। বেসরকারি চাকরিজীবীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শুধু চাকরি-পরবর্তী এককালীন কিছু আর্থিক সুবিধা পান। তবে সরকারি চাকরিজীবীরা পেনশন সুবিধা ভোগ করেন।
এ অবস্থা কেবল বাংলাদেশে নয়, বর্তমানে এশিয়ার অন্যান্য দেশেও অবসর গ্রহণের পর ক্রমবর্ধমান বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা বিধানে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেই। এসব মানুষ সাধারণত সন্তানের ওপর নির্ভরশীল বা সমাজের গলগ্রহ হয়ে জীবনের শেষ অংশ পার করেন। সামাজিক অবক্ষয় এবং মানবিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অভাবে অনেক সন্তানই বৃদ্ধ অভিভাবকের দায়ভার বহন করে না। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, বিপুলসংখ্যক বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক, যারা জীবনের কর্মক্ষম সময়ে দেশে প্রয়োজনীয় সেবা দিয়েছেন এমনকি সারা জীবন আয়ের ওপর কর দিয়ে উন্নয়নে অবদান রেখেছেন, তারা একটা পর্যায়ে কর্মশক্তি হারানোর পর আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
বৃদ্ধদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সহজ হবে না। এটি এ অঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে একবিংশ শতকের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ এশিয়ার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ। কৃষি ও শিল্পনির্ভর এ অঞ্চলে কর্মক্ষম জনশক্তিই উন্নয়নের বাহক। তাই একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অনুৎপাদনশীল ও অসমর্থ হয়ে পড়লে এবং এর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে তা বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তবে তারা যদি আত্মনির্ভরশীল হতে পারেন, তাহলে এ ঝুঁকি কমে যাবে অনেকাংশে। সব শ্রম ও পেশাজীবী নাগরিকের জন্য পেনশন স্কিম বা আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। এছাড়া নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়ে যথেষ্ট গবেষণা ও নতুনত্বের মাধ্যমে উপযুক্ত বিকল্প উপায় খুঁজে বের করা প্রয়োজন। এটা মনে করা অযৌক্তিক যে, বয়োজ্যেষ্ঠরা নির্দিষ্ট বয়সের (৬০ বছর) পর পুরোপুরি অকর্মণ্য বা অক্ষম হয়ে পড়েন। তাদের সারা জীবনের সঞ্চিত কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতা পুনরায় কাজে লাগানোর উপায় খুঁজে বের করা যায়। আমরা দেখি, অবসর গ্রহণের পর অনেক সরকারি কর্মকর্তা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা দিয়ে থাকেন। একইভাবে কায়িক শ্রমনির্ভর পেশাজীবীদের ক্ষেত্রেও মানবসম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের কম পরিশ্রমের কাজের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে পুনর্বাসন সম্ভব। পাশাপাশি তাদের সুলভ কিন্তু উন্নত মানের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। মুসলিম অধ্যুষিত এ দেশে জাকাত প্রক্রিয়াকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমেও বয়স্কদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা যায়। এমনকি প্রতিদিন বা প্রতিমাসে নির্দিষ্ট হারে টাকা জমা রাখার মাধ্যমেও শ্রমিক, দিনমজুরসহ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য পেনশন স্কিম তৈরি করা যায়। তবে এসব পদ্ধতি গ্রহণের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পুরো কাঠামোতে সুশাসন নিশ্চিত করা।
জনহিতৈষী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, যা জনগণের জীবনমান উন্নয়নে রাখছে অবদান। সে পথ ধরে আমরা আশা করতে পারি, সরকার বয়স্ক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যগত ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল (এনএসএসএস) যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করবে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের
সম্পাদকীয় অবলম্বনে