ইসমাইল আলী: বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় দুই বছর ধরে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এতে ঘাটতি বাড়ছে উৎপাদন ব্যয় ও বিদ্যুতের দামের মধ্যে। এ ঘাটতি পূরণে গত অর্থবছর ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা ভর্তুকি চাওয়া হয়। যদিও জুন পর্যন্ত মাত্র সাত হাজার ৪০০ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি চাহিদা আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবছর ভর্তুকি পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান সংশ্লিষ্টরা।
গত ৮ জানুয়ারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির গণশুনানিতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) জানতে চায়, চলতি অর্থবছর সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ভর্তুকি দেয়া হবে কিনা। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি একাধিকবার বলা হয়েছে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে আর ভর্তুকি দেয়া হবে না। যদি প্রকৃতপক্ষেই ভর্তুকি না দেয়া হয় তবে চাহিদা মেটাতে বিদ্যুতের দাম দ্বিগুণ হয়ে যাবে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে।
পিডিবির তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছর নিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৮৩ হাজার ৯৩৩ মিলিয়ন কিলোওয়াটঘণ্টা। ৩ শতাংশ ট্রান্সমিশন লস বিবেচনায় এ বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি ৮ টাকা ৯৬ পয়সা। যদিও বাল্ক মূল্যহার ছিল ৫ টাকা ০৯ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে পিডিবির ঘাটতি দাঁড়ায় ৩ টাকা ৮৭ পয়সা। এ ঘাটতি মেটাতে মোট প্রয়োজন ছিল ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা।
যদিও গত অর্থবছর ভর্তুকি বাবদ সরকার ছাড় করে ১২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরের বকেয়া ভর্তুকি ছিল পাঁচ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এতে গত অর্থবছরের জন্য নিট ভর্তুকি দেয়া হয় সাত হাজার ৪০০ কোটি টাকা। আর ২২ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা ভর্তুকি বকেয়া রয়ে গিয়েছিল। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে এ অর্থ গত অর্থবছরের চাহিদা মেটাতেই ব্যয় হয়ে যাবে। এরপরও পাঁচ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বকেয়া রয়ে যাবে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুতের ভর্তুকিসহ ও ভর্তুকিবিহীন ইউনিটপ্রতি ব্যয় ও দামের হিসাব করেছে পিডিবি। এতে দেখা যায়, গত অর্থবছর ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ছিল ৮.৯৬ টাকা। এর সঙ্গে হুইলিং চার্জ ২৯ পয়সা যুক্ত হয়। এছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় ছিল গড়ে ৯ টাকা ২৫ পয়সা। আর বিদ্যুৎ গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছাতে বিতরণ লোকসান ও ব্যয় ছিল যথাক্রমে ইউনিটপ্রতি ১০ টাকা ০৫ পয়সা ও এক টাকা ২১ পয়সা। সব মিলিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় দাঁড়ায় গড়ে ভর্তুকি বাদে ১১ টাকা ২৬ পয়সা। যদিও ভর্তুকি দিয়ে এ বিদ্যুৎ গ্রাহকের কাছে বিক্রি করা হয় ৭ টাকা ১৩ পয়সায়।
এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে নিট বিদ্যুৎ উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৭৯৬ মিলিয়ন কিলোওয়াটঘণ্টা। এতে ট্রান্সমিশন লসসহ ইউনিটপ্রতি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১১ টাকা ৭৫ পয়সা। এ বিদ্যুতের বিক্রি মূল্য ছিল ৫ টাকা ০৯ পয়সা। তবে ডিসেম্বর থেকে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ টাকা ২০ পয়সা। এর সঙ্গে হুইলিং চার্জ ২৯ পয়সা যোগ হবে।
চলতি অর্থবছর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন মাসে গড়ে ১২ টাকা ০৪ পয়সা। আর বিদ্যুৎ গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছাতে বিতরণ লোকসান ও ব্যয় ছিল যথাক্রমে ইউনিটপ্রতি ১৩ টাকা ০৮ পয়সা ও এক টাকা ২১ পয়সা। সব মিলিয়ে তিন মাসে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় দাঁড়িয়েছে গড়ে ভর্তুকি বাদে ১৪ টাকা ২৯ পয়সা।
যদিও শুনানিতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের গড় মূল্যহার বাড়িয়ে ৮ টাকা ২৩ পয়সা নির্ধারণে সুপারিশ করেছে বিইআরসির কারিগরি কমিটি। এটি বাস্তবায়ন হলেও প্রতি ইউনিটে ঘাটতি থেকে যাবে ৬ টাকা ০৬ পয়সা। তবে যদি গ্রাহক পর্যায়ে দাম না বাড়ানো হয় তাহলে প্রতি ইউনিটে ঘাটতি দাঁড়াবে ৭ টাকা ১৬ পয়সা।
জানতে চাইলে পিডিবির ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, সরকার গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দামে কোনো ভর্তুকি দেয় না। তবে বাল্কে ভর্তুকি দেয়া হলেও গত অর্থবছর থেকে চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দিচ্ছে না। ভর্তুকি তুলে দিলে বাল্ক মূল্যহার বেড়ে যাবে। আর বাল্ক মূল্যহার বেড়ে গেলে গ্রাহক পর্যায়েও বিদ্যুতের দাম দ্বিগুণ করতে হবে। না হলে বড় ধরনের লোকসানে পড়বে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো।