৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিলের খবরটি জানতে পারি ৯ নভেম্বর সন্ধ্যায়, রাঁচীতে বসে। অথচ ঘোষণাটি দেওয়া হয় ৮ নভেম্বর রাতে। নগদ লেনদেন কমাতে ও ডিজিটাল ট্রানজেকশনে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদি। মোদি সরকারের ডিজিটাল ইন্ডিয়া গঠনের একগুচ্ছ পরিকল্পনার মধ্যে ছিল এমন প্রস্তাব। তবে এমন গুরুত্বপূর্ণ খবর দিল্লি থেকে ঝাড়খণ্ডের রাজধানী ও প্রধান শহর রাঁচী পৌঁছতে একদিনের বেশি সময় চলে যাওয়ায় ডিজিটালাইজেশনের দুর্বলতা নিয়ে ব্যঙ্গ করেছিলেন প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। স্বল্প আয়ের মানুষ গুজব মনে করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন নোটবন্দির খবর। অনেকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন, তারা নোট বদলাবেন না। সেই দলে আমিও ছিলাম। তবে প্রথম সন্ধ্যাতেই যে বড় নোটগুলো যে অচল হয়ে গেছে, এমন দুর্ভাবনাও মনে উঁকি দিচ্ছিল। তাই বিদেশে কোনো ঝুঁকি না নিয়ে কাছে থাকা দুটি ৫০০ ও একটি ১০০০ রুপির নোট বদল করে নিয়েছিলাম। না হলে ভারত ভ্রমণে থাকা হাজার হাজার বাংলাদেশি পর্যটকের মতো বিস্তর ভোগান্তি পোহাতে হতো।
দুর্ভাবনা সত্যিই শঙ্কায় রূপ নেয় পরদিন সকালে। সেদিন থেকে কেউই বড় নোটে লেনদেন করতে পারছিলেন না।
দুদিনের মধ্যে সব বড় নোট ব্যাংকে জমা দিতে হবেÑরাঁচীর প্রথম সন্ধ্যায় এমনই শুনেছিলাম। আর যে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দিতে পারলেই চলবে। ২০০০ রুপির নতুন নোট আসছে ইত্যাদি কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল। তবে ১০ নভেম্বর কলকাতায় এসে জানতে পারি, ৫০ দিনের মধ্যে টাকা জমা দেওয়ার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে সরকার। পঞ্চাশ দিন, মেনে নিনÑএমন অনুরোধ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। আরও জানতে পারি, টাকাগুলো জমা দিয়ে সমপরিমাণ অর্থ তোলা যাবে কেবল নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে।
নোটবন্দির কারণ জানা ছিল না রাঁচী বা কলকাতাবাসীর; এখনও এর কারণ অজানা। রেলস্টেশন, মাছ-মুরগির বাজার, জুতার দোকান ঘুরে বুঝতে পেরেছিলাম, জালনোট সরাতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই শুরু থেকে কালো টাকার বিরুদ্ধে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের ধারণা আজও স্পস্ট হয়নি। নতুন নোটে প্রযুক্তির ব্যবহার থাকবে, জালনোট তৈরি করা যাবে না। অর্থাৎ অসৎ উপার্জনকারীদের শায়েস্তা হবেÑএমন সম্ভাবনায় খুশিও ছড়িয়েছিল ভারতবাসীর মনে। তাই নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে চমক ছিল। এমন চমক ১৯৭৮ সালেও দেখেছিল ভারতের মানুষ। তখন ১০০০ রুপির সঙ্গী ছিল ৫,০০০ ও ১০,০০০ রুপির নোট।
এবারের চমকের সঙ্গে ভর করেছে অসহনীয় দুর্ভোগ। কে কার আগে ব্যাংকের সামনে দাঁড়াতে পারবেন, কত দ্রুত নোট নিতে পারবেনÑএমন তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। দৈনিক কাজে হাজিরার চেয়ে জমিয়ে রাখা নোটগুলো ছোট করায় ব্যস্ত সবাই। কেননা তাদের সঞ্চয়ে সরাসরি কুঠারাঘাত করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে সমস্যা মিটে যাবে। ভোগান্তি দূর করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে; কিন্তু অব্যবস্থাপনা পিছু ছাড়েনি। ঘোষিত পঞ্চাশ দিনের একেবারে শেষে এসে দেখা গেল, এটিএম মেশিনগুলো নতুনভাবে কনফিগার করা হয়নি। কালো অর্থনীতির কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা নিয়ে সরকারের তরফ থেকে কোনো পরিসংখ্যান নেই, নেই কোনো উচ্চবাচ্য। তাছাড়া সমবায় ব্যাংকগুলোকে এ প্রক্রিয়ার আওতায় আনা হয়নি। আর নোট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে থেকেই রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায় ১৪ পরিচালকের মধ্যে মাত্র চারজনকে রাখা হয়েছিল। ফলে সমস্যা আরও বাড়ে। রক্তারক্তির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল নোটবন্দি কারবারÑএখন পর্যন্ত দেশটিতে এ কারণে প্রায় ১০০ জন মারা গেছেন। আহতের হিসাব নেই।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদি পঞ্চাশ দিন শেষ হলে থামবেন, নাকি তার ঝুলিতে আরও চমক রয়েছে? রুপির পরে কি নজর দেবেন আবাসন ও সোনার বাজারে? প্রসঙ্গত দেশটিতে হাজার হাজার কোটি রুপি লগ্নি করা আছে জমিজমা ও স্বর্ণ খাতে। আদৌ কালো রুপি উদ্ধারের পথে কি আছে মোদি সরকার? নাকি ডিজিটাল সিস্টেমে লেনদেন করিয়ে ডিজিটাল ভারতবাসী গড়ায় মন দিয়েছেন? অর্থ লেনদেনে ডিজিটালাইজেশনের ধুয়া ইতোমধ্যে ছড়িয়ে গেছে, ফিকে হয়ে গেছে অসৎ উপায়ে উপার্জিত রুপি বাতিলের কথা। এখনও পরিষ্কার নয় কেন বাতিল করা হয়েছে নোটগুলো। নতুন ২০০০ রুপির নোটে ঘুষ দেওয়া-নেওয়া কি চলছে না? অপ্রদর্শিত খাতে অর্থের চলে যাওয়াও তো থেমে নেই।
হয়তো মোদি সরকার এখন নতুন ঘোষণা নিয়ে ব্যস্ত। এ সময়টুকু অধীর আগ্রহে থাকবে ভারতবাসী। নোট বাতিলের মতো নতুন কোনো ঘোষণা নিয়ে জল্পনা, কল্পনা চলছে তাদের মধ্যে। ১ জানুয়ারি আবার হয়তো গোপনে নতুন কোনো প্রতিযোগিতার মুখে ফেলে দেওয়া হবে ভারতসন্তানদের। দেশকে এগিয়ে নিতে, নাকি পিছিয়ে দিতে আরও পঞ্চাশ দিন নোটবন্দি করে রাখবেন, সে আশঙ্কা তো থাকছেই।
প্রায় পঞ্চাশ দিন আগে চিকিৎসা, ব্যবসা, পড়ালেখা, ভ্রমণ ইত্যাদি নিয়ে ভারত ভ্রমণে থাকা বাংলাদেশিরা যেমন ভোগান্তিতে পড়েছেন, তেমনি এ সময়ে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ভারতমুখো হয়েছেন খুব কম মানুষ। নোট বাতিলের নতুন ঘোষণা নিয়ে আমরাও তাই আগ্রহী। তবে ঢাকায় বসে হালনাগাদ তথ্য কবে জানতে পারবো, তার কোনো নেই। কেবল ভারতবাসী নয়, দেশটিতে ভ্রমণে যাওয়া মানুষের ওপর দুর্ভোগ চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। নোট প্রত্যাহারের কারণে ১৯৭৮ সালে মোরারজি সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা হারানোর অভিজ্ঞতাও কাজে লাগাতে পারেন মোদিজী। প্রস্তুতি নিয়ে পরিকল্পিত ঘোষণা আসুক মোদি সরকার থেকে।
আদিত্য রায়হান
ঢাকা