সোনিয়া খান লিমা: রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায়ে বাংলার একদল দামাল ছেলের বজ দাপটে প্রকম্পিত ছিল ঢাকার অলিগলি। দাবি ছিল মায়ের ভাষায় মাকে ডাকার স্বাধীনতা। পাকিস্তানি আগ্রাসন থেকে মায়ের কণ্ঠে শোনা বাংলা ভাষায় দাফতরিক কাজ করা এবং লেখার স্বাধীনতা চাওয়াই ছিল ভাষা আন্দোলনের মূল পটভূমি। যে আন্দোলনের ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান।
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবির আন্দোলনে সহযোদ্ধা হয়ে পুরুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলার নারীরাও। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও পুলিশের তাক করা বন্দুকের নল উপেক্ষা করে ভাষার দাবির মিছিলগুলোয় নারীরা ছিলেন সামনের কাতারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা রাতে লুকিয়ে ভাষার দাবিতে রঙ-তুলি দিয়ে বিভিন্ন স্লোগান সংবলিত পোস্টার আঁকতেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নারীরা ধাক্কাধাক্কি করে পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙেন এবং বেশ কজন নারী আহত হন। আহতদের চিকিৎসায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রীরা। তাদের চিকিৎসা-সাহায্যের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েরা চাঁদা তুলে সহযোগিতা করেন। পুলিশের তাড়া খাওয়া ও পালিয়ে থাকা ছাত্রদের বিভিন্নভাবে লুকিয়ে রাখেন। আন্দোলনের খরচ চালানোর জন্য অনেক গৃহবধূ অলংকার খুলে দেন। শুধু তা-ই নয়, ভাষা আন্দোলনে জড়িত হওয়ায় অনেক নারীকে জেলও খাটতে হয়েছে। কেউ হারিয়েছেন সংসার। কেউ আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে হয়েছেন বহিষ্কার।
ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নারীদের অনবদ্য ভূমিকা ছিল। ১৯৪৭ সালের আগস্টে অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে বাংলা ভাষার দাবিকে চাঙ্গা করতে গঠিত হয় ‘তমদ্দুন মজলিস’। আবুল কাসেমের স্ত্রী রাহেলা, বোন রহিমা এবং রাহেলার ভাইয়ের স্ত্রী রোকেয়া আন্দোলনকারীদের আজিমপুরের বাসায় দীর্ঘদিন খাইয়েছেন, জেলও খেটেছেন।
১৯৪৮ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় সভায় ছাত্রী প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন বলেন, ‘বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি স্বীকার করিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনে মেয়েরা রক্ত বিসর্জন দেবে।’ আন্দোলনের শুরুর দিকে এক ছাত্রীর মুখে এমন সাহসী উচ্চারণ কর্মীদের মনে উদ্দীপনা জোগাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
১৯৪৮ সালের ঘটনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘১১ মার্চ ভোরবেলা থেকে শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করে। সকাল ৮টায় পোস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের ওপর ভীষণ লাঠিচার্জ হয় এবং কয়েকজন ছাত্রীও মার খেয়েছিল।’
আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু আরও লেখেন, ‘যে পাঁচ দিন আমরা জেলে ছিলাম, সকাল ১০টায় স্কুলের মেয়েরা গার্লস স্কুলের ছাদে উঠে ব্যানার হাতে স্লোগান দিতে শুরু করতো, আর ৪টায় শেষ করতো। ছোট ছোট মেয়েরা একটু ক্লান্তও হতো না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’এমন নানা ধরনের স্লোগান ।’
পরে ’৫২-এর ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীন কর্তৃক জিন্নাহর ঘোষণার পুনরাবৃত্তি হলে মহান একুশের মূল ক্ষেত্র তৈরিতে ছাত্রীরা সাহসী ভূমিকা রাখেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন কলেজের ছাত্রীরা আন্দোলন চাঙ্গা করতে অর্থ সংগ্রহ ও রাতভর পোস্টার লেখার কাজ করেন।
২১ ফেব্রুয়ারি বর্তমান জগন্নাথ হলে চলা অ্যাসেম্বলিতে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য আনোয়ারা খাতুন প্রতিবাদী বক্তব্যে বলেন, ‘মিস্টার স্পিকার, পুলিশের লাঠিচার্জে মেয়েরা আহত হয়েছে। মেয়েদের আহতের সংখ্যা আটজন। মন্ত্রিসভা এমন একটা আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছে যাতে নাকি মেয়েরা পর্যন্ত লাঞ্ছিত হয়েছে।’
ঢাকার বাইরে নারীরা ভাষা আন্দোলনে একাত্ম হতে গিয়ে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের মমতাজ বেগমের কথা সবার জানা। কারা নির্যাতনের এক পর্যায়ে সরকারের চাপে স্বামী তাকে তালাক দেন এবং গ্রেফতার হন।
সিলেটের কুলাউড়ার সালেহা বেগম ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী থাকাকালীন ভাষাশহীদদের স্মরণে স্কুলে কালো পতাকা উত্তোলন করেন। এ অপরাধে সেখানকার ডিসি ডি.কে. পাওয়ারের আদেশে স্কুল থেকে তাকে তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। সে কারণে সালেহা বেগমের পক্ষে আর পড়ালেখা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
চট্টগ্রাম ও সিলেটে ছাত্রীরা আন্দোলনে জোরালো ভূমিকা রাখেন।
ভাষা আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণে সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটে ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ১৪৪ ধারা ভাঙার দায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ ছাত্রী গ্রেফতার হন। তাদের মধ্যে লায়লা নূর, প্রতিভা মুৎসুদ্দি, রওশন আরা বেনু, ফরিদা বারী, জহরত আরা, কামরুন নাহার লাইলি, হোসনে আরা, ফরিদা আনোয়ার ও তালেয়া রেহমান অন্যতম।
সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের প্রক্টরের অনুমতি নিয়ে ও প্রক্টরের সামনে পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে হতো। গ্রামের নারীরা তো ছিলেন পর্দা প্রথার আড়ালে বন্দি। এমন সময় সামাজিক, ধর্মীয়, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় বাধা-বিপত্তি ঠেলে বাংলা ভাষার দাবিতে নারীদের রাজপথে নেমে আসা ছিল বিরাট ব্যাপার। পুলিশি বাধা ছাড়া ছাত্রদের তেমন কোনো বাধা না থাকলেও নারীরা কিন্তু স্বামী-সংসার, সন্তানদের মায়া ত্যাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ভাষা আন্দোলনে।
ভাষা আন্দোলনসহ স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। ছেলেদের পাশাপাশি নারীদের এ অবদান আজ আমাদের বাংলায় কথা বলতে, বাংলা স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ লিখতে, কবিতা-গান-উপন্যাসসহ সাহিত্যকে উঁচু করে দাঁড় করিয়েছে।
শিক্ষার্থী, বাণিজ্য অনুষদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়