আহ্মদ ইকরাম আনাম: দেরিতে হলেও আমাদের একটি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন হয়েছে ২০০৯ সালে। বিশ্বের বড় দেশগুলোতে ভোক্তা বা গ্রাহকশ্রেণির অধিকার রক্ষায় এ ধরনের আইনের অস্তিত্ব নতুন নয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন পণ্য বা সেবাদাতা গোষ্ঠী যতটা সংঘবদ্ধ, ভোক্তা বা গ্রাহকশ্রেণি ততটাই অসংগঠিত। ফলে বিভিন্ন সময় ভোক্তাশ্রেণি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি দ্বারা আর্থিক, শারীরিক কিংবা মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে। আইন হওয়ার আগে তো বটেই, এমনকি এখনও ভোক্তারা জেনে বা না জেনে প্রতারণার শিকার হন। পশ্চিমবঙ্গে ভোক্তাশ্রেণির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একাধিক ঘটনা আমরা অতীতে শুনেছি। যেমন, সেখানে একবার লবণের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমজনতা নাকি লবণ খাওয়া বাদ দিয়েছিল। তখন ব্যবসায়ীরা লবণের দাম কমাতে বাধ্য হয়েছিলেন। এমন আরেকটি ঘটনা বছর দুয়েক আগে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় ঘটেছিল। একটি গবেষণা কাজে সেখানে গিয়ে শুনেছিলাম, বাসে যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করায় ওই কোম্পানির সব বাসে যাতায়াত এলাকার লোকজন বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে বাস মালিক ও শ্রমিক নেতারা স্থানীয়দের কাছে ক্ষমা চেয়ে পুনরায় বাসসেবা চালু করতে সক্ষম হয়। সমাজে সবকিছুর মান সমুন্নত রাখতে এ ধরনের চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের কোনো বিকল্প নেই। অনেক সময় শুধু আইন দিয়ে সব অন্যায় রোখা যায় না। প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা, আন্দোলন ও প্রতিরোধ।
এমন একটি কথা প্রায়ই শোনা যায়, বাংলাদেশে অনেক আইন আছে; কিন্তু একটা বড় অংশেরই প্রয়োগ নেই। এক্ষেত্রে একতরফা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও দোষ দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে না এ কারণে যে, আমজনতা সচেতন ও প্রতিবাদী না হলে ঘরে ঘরে গিয়ে সব আইন প্রয়োগ সম্ভব নয়। আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে যুক্ত এমন মানুষমাত্রই জানেন, সাধারণত সমাজের ৯০ শতাংশ মানুষ ভালো ও ১০ শতাংশ মন্দ হওয়ার কথা। সেই ৯০ শতাংশকে ১০ শতাংশের হাত থেকে রক্ষা করাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ। কিন্তু সমাজের সিংহভাগে দুর্বৃত্তায়ন ঘটলে এককভাবে কোনো সংস্থার পক্ষে তার প্রতিকার দুষ্কর। তবে আনন্দের বিষয়, সম্প্রতি ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে একাধিক আইন সম্পর্কে মানুষ সচেতন হয়েছে। তার মধ্যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ অন্যতম। ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ওজনে কারচুপি, পণ্যের মোড়কের গায়ে দাম, মেয়াদ প্রভৃতি না লেখা, পণ্যে ভেজাল মেশানো, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য কিংবা সরকার নির্ধারিত দাম বা ভাড়ার অধিক রাখার বিষয়ে অভিযোগ আমরা বহুদিন থেকে শুনে আসছি। এসব রোধে তখন সুনির্দিষ্ট আইনের অভাব ছিল। ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার পরও তা কিছুটা অকার্যকর ছিল জনসচেতনতার অভাবে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, কোনো হোটেল, রেস্তোরাঁ কিংবা পরিবহন সংস্থা গ্রাহক বা ক্রেতার সঙ্গে উল্লিখিত আইনবিরোধী কাজ করে থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তা বা গ্রাহক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিক্রেতা বা সেবাদাতার ছবি ও অন্য প্রমাণ উপস্থাপন করছেন। তখন অন্যরা তাকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের নির্ধারিত ফরমে ই-মেইলের মাধ্যমে অভিযোগ জানানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। গত দু-তিন বছরে অনেকেই এভাবে অভিযোগ করে প্রতিকার পেয়েছেন। আইনানুসারে, ক্ষতিপূরণের ২৫ শতাংশ অর্থও পেয়েছেন তারা। মোটকথা, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিয়ে সাধারণ মানুষ এখন মোটামুটি সন্তুষ্ট। এ সচেতনতার কারণে বিভিন্ন পণ্য ও সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সচেতন হয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে। এর মধ্যে এমআরপি বা সর্বোচ্চ খুচরা দামের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যেসব ফিনিশড পণ্যের মোড়কের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা দাম লেখা থাকে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯’র ৪০ ধারা অনুসারে এর অধিক দাম রাখলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং তাতে অভিযুক্তকে অনূর্ধ্ব এক বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী খাবার পানি, কোমল পানীয় ও আইসক্রিমের দাম নিজেদের রেস্তোরাঁয় সর্বোচ্চ খুচরা দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করে বলে প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায়। এর সত্যতা মিললে ভোক্তা রসিদের ছবিসহ নির্দিষ্ট ফরম্যাটে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে অভিযোগ করলে তারা যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। ফলে অনেক রেস্তোরাঁ এখন এসব পণ্য সর্বোচ্চ খুচরা দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। উল্লেখ্য, সর্বোচ্চ খুচরা দামের সঙ্গে সব কর ও সার্ভিস চার্জ যুক্ত থাকে, এর চেয়ে বেশি দাম কোনোভাবেই রাখা সম্ভব নয়। কেউ যদি সর্বোচ্চ খুচরা দামের ওপর ভ্যাট ধার্য করেন, তবে তিনি পরিষ্কার আইনের লঙ্ঘন করছেন।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ধারা ৪১ ও ৪২ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৪১-এ বলা হয়েছে ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে শাস্তির কথা। আর ধারা ৪২-এ উল্লেখ করা হয়েছে খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণে সাজার কথা। ধারা দুটির অধিক গুরুত্বের কারণ হলো, এ অপরাধগুলো আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসনের মোবাইল কোর্টে প্রায়ই আমরা এ অপরাধে সাজার কথা পত্রপত্রিকা ও টিভির খবরে দেখতে পাই। তবু অপরাধ কোনোক্রমেই কমছে না। শাকসবজি, ফলমুল, মাছ-মাংস, রেস্তোরাঁর খাবারে প্রতিদিনই মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের একটি শ্রেণি কোনোভাবেই এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। উল্লিখিত আইনের ৪১ ও ৪২ ধারার অপরাধে শাস্তি অনূর্ধ্ব তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। অপরাধের মাত্রা হিসাব করলে এ সাজা লঘুই বলা চলে। অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার একটি কলামে বলেছিলেন, ইংল্যান্ডে নাকি কোনো মানুষকে হত্যার জন্য সহজে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় না। কিন্তু পণ্যে বিশেষত খাবার বা ওষুধে বিষাক্ত উপাদান মেশানোর দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এ কারণে যে, তা বহু মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে, আলোচ্য আইনের ৪৪ ধারায় বলা হয়েছে মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করার ক্ষেত্রে দণ্ডের কথা। এটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এক পণ্যের কথা বলে অন্য পণ্য গছিয়ে দেওয়ার প্রবণতা একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রকট। অনেক বড় প্রতিষ্ঠানও প্রচারের স্বার্থে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন নির্মাণ করে বটে; কিন্তু মূল পণ্যে বিজ্ঞাপনের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে ধারা ৪৪ অনুসারে, অপরাধীকে অনূর্ধ্ব এক বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। একইভাবে ধারা ৪৬ থেকে ৪৯ পর্যন্ত বলা হয়েছে ওজন বা পরিমাপে কারচুপির দণ্ডের কথা, ধারা ৫০-এ পণ্যের নকল প্রস্তুতে সাজা এবং ধারা ৫১-তে মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বা ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে দণ্ডের বর্ণনা।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯’র ধারা ৫-এ একটি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ গঠনের কথা বলা হয়েছে, যার চেয়ারম্যান হবেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতিও এ পরিষদের একজন সদস্য। আইনের ধারা ১০(১) অনুযায়ী, দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কমিটি থাকবে, যার সভাপতি হবেন ওই জেলার প্রশাসক। অর্থাৎ জেলা পর্যায়ে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অভিযোগ করতে চাইলে এ জেলা কমিটির শরণাপন্ন হতে পারবে।
বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ডিজিটাল উপস্থিতি সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে উপকৃত করে চলেছে। বিশেষ করে ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারি একাধিক সংস্থার উপস্থিতি বহু মানুষের কাছে সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে এবং তাদের করে তুলছে সচেতন। এর মধ্যে বিমানবন্দরের ম্যাজিস্ট্রেট, ভ্যাট গোয়েন্দা, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর প্রভৃতি সংস্থা উল্লেখযোগ্য। তাদের পেজ ব্যবহার করে সচেতন অনেকেই অভিযোগ করছেন মূলত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯’কে ভিত্তি করে এবং প্রতিকারও পাচ্ছেন দ্রুত। আইন লঙ্ঘনকারীরাও আইন মানতে বাধ্য হচ্ছেন। আর সরকারি সংস্থার সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্বও কমছে। বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক ও সম্ভাবনাময়।
ফ্রিল্যান্স লেখক