প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

ভোজ্যতেলে আস্থাহীনতা ও একটি উদ্যোগ

জাহিরুল ইসলাম

একসময় ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষার ব্যবহার ছিল সবচেয়ে বেশি। এরপর ধীরে ধীরে সে স্থান দখল করে সয়াবিন ও পামঅয়েল। তারপর বাজারে আসে রাইস ব্র্যান অয়েল। দোকানির সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, এর বাজারও বাড়ছে ক্রমে। সংবাদপত্রে পড়েছি, তুলাবীজ থেকেও এখন উৎপাদন হচ্ছে ভোজ্যতেল। ওই প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়েছিল, প্রায় ১৮ শতাংশ তেল থাকে তুলাবীজে। খুব সম্ভবত দামও উল্লেখ ছিল তাতে। সেটা এখন ঠিক মনে পড়ছে না। দেখছি, স্বাস্থ্যসচেতনতা বেড়ে ওঠার সঙ্গে নতুন নতুন উৎস থেকে ভোজ্যতেল উৎপাদনের খবর আসছে। এসবে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কম তা নেই। কোনোটা নাকি কমায় ক্ষতিকর কোলেস্টেরল। দাম কিছুটা বেশি হলেও মানুষ তাই ঝুঁকছে ওসবের প্রতি। তারা চাচ্ছে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে। তাই দামটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয় অনেকের কাছে।

সরিষার তেলের চাহিদা যে এখন একেবারে নেই, তা নয়। স্বাস্থ্যসচেতন জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখনও আছে এ তেলের ব্যবহার। কারণ তরকারির কিছু পদ আছে, যেগুলোয় সরিষার তেল না হলে চলে না। কয়েক দিন আগে সরিষার তেল কিনতে গিয়ে দোকানিকে বলেছিলাম, খাঁটি না হলে দেবেন না। তিনি বললেন, এই তো ফেললেন বিপদে! ভালো দোকানির এই এক গুণ। গ্রাহকের বিশ্বস্ততা নষ্ট করতে চান না। হাসতে হাসতে বললেন, খাঁটি সরিষার তেল তো আমার কাছে কয়েক রকম আছে। কোনটা দেব আপনাকে? লক্ষ করলাম, যে কয়টি বোতল ও প্যাকেট তিনি দেখালেন, সবগুলোতেই আছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) লোগো। পণ্যের মান যাচাই ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব এ প্রতিষ্ঠানের। প্রশ্ন জাগলো, এ প্রতিষ্ঠানের লোগোসংবলিত একই পণ্য কী ভিন্ন ভিন্ন মানের হতে পারে? সেটা যদি বাজারে বিদ্যমান থাকে, তাহলে এ প্রতিষ্ঠান বা ওই পণ্যের প্রতি মানুষ আস্থা রাখবে কীভাবে?

দোকানির বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, বাজারে খাঁটি সরিষার তেল বলে যেসব প্যাকেট বা বোতল রয়েছে, সেগুলোয়ও আছে সন্দেহ। পেছনে যে আসলে কী হচ্ছে, কে জানে! ভেজাল তেলের ফলে শুধু যে ভোক্তার স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে তা নয়, ব্যবসাও হারাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। এ উপলব্ধি কী তাদের আছে? অন্যান্য উৎস থেকে উৎপাদিত তেলের পরিভোগ বৃদ্ধির সঙ্গে সরিষার ভোগ কতটা কমে গেছে জানা নেই। এও সত্য, বাজারে হরেক মানের সয়াবিন তেল পাওয়া যায়। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, যেসব ভোক্তা সয়াবিন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, তারা কি এটা করছেন শুধু স্বাস্থ্যসচেতনতা থেকে? নাকি তেলের মান নিয়ে আস্থাহীনতাও কাজ করছে এর পেছনে?

উদ্ভূত বাস্তবতায় প্রশ্ন তোলা হয়তো অসঙ্গত হবে না। বাজারে নতুন আসা যেসব তেল আমরা খাচ্ছি, সেগুলোর মান যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে কি? রাইস ব্র্যান অয়েল এক সময় একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করতো। এখন আরও প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে। নতুন পণ্য মানুষকে গ্রহণ করানোকেই মার্কেটিংয়ে দেখা হয় সফলতা হিসেবে। এভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টায় নতুন পণ্য বাজার পেয়ে গেলে আরও অনেকে চেষ্টা চালান ওই মার্কেটে ভাগ বসাতে। দাম কমিয়ে বাজার ধরার কৌশলও কাউকে অবলম্বন করতে দেখা যায়। এ অবস্থায় বাজারে নতুন আসা তেলগুলোর ক্ষেত্রে কী পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে বাস্তবতা এখন এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন অনেক কিছু। সম্ভবত এ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই সিলেটের এক উদ্যোক্তা একে নিয়েছেন ব্যবসায়িক কৌশল হিসেবে। পিকআপ ভ্যানে সরিষা ভাঙার মেশিন স্থাপন করে বাজারের বিভিন্ন পয়েন্টে আখের রস যেমন বিক্রি হয়, সেভাবে তিনি বিক্রি করছেন সরিষার তেল। চোখের সামনে মেশিনে ভাঙানো সরিষা থেকে উৎপাদিত তেল মানুষ কিনছে লাইন ধরে। দামও বাজারমূল্যের খুব বেশি নয়। সম্প্রতি এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করি সিলেটের প্রাণকেন্দ্র বন্দরবাজারে। মানুষ এত বেশি আগ্রহ নিয়ে ওই তেল কিনছে যে, দেখে মনে হলো তার স্টকে থাকা সরিষা ও তেল শেষ হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। তবে অন্য একজনের কাছে তার ব্যাপারে জেনেছি, ওই ব্যক্তি মৌসুমে সরিষা স্টক করেন। পরে সেটা পর্যায়ক্রমে বিক্রি করেন তেল বানিয়ে। এ ব্যবসা পরিচালনা করতে দৈনন্দিন কী পরিমাণ সরিষা তার প্রয়োজন আর কী পরিমাণ তিনি স্টক করেন, এতে লাভ কীরকম হচ্ছে এসব জিজ্ঞাসা ছিল তার কাছে। কিন্তু সেসব জানা হয়নি। ক্ষুদ্র উদ্যোগ হলেও তার পণ্যের চাহিদা দেখে বোঝা গেল, উল্লেখযোগ্য লাভের ভিত্তিতেই পরিচালিত হচ্ছে ব্যবসাটি।

সরিষা ভেঙে তেল উৎপাদনের মেশিন এখনও দেখা যায় অনেক বাজারে। ঘানির প্রচলনও রয়ে গেছে বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ মেশিনে তেল বানিয়ে বিক্রির উদ্যোগ আগে চোখে পড়েনি। উদ্যোক্তার কাছে জানার ইচ্ছে ছিল, এ ব্যবসার আইডিয়া তিনি পেলেন কীভাবে? আমার ফেরার তাড়া ছিল। তাই কথা বলা হয়নি। এমন ব্যস্ততার মধ্যে কারও সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলার পরিবেশও থাকে না। তবে ধারণা করি, সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে পরিচালনা করতে পারলে এ উদ্যোগ জনপ্রিয় হবে। ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে লাভের পরিমাণও বাড়াতে পারবেন তিনি।

শ্রদ্ধাভাজন এক সাংবাদিক কিছুদিন আগে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের একটি বিজ্ঞাপন দেখার জন্য ইউটিউবের লিংক পাঠিয়েছিলেন ফেসবুক ইনবক্সে। ওই বিজ্ঞাপনের একটি বাক্য এ রকমÑকেউ কেউ দেখে প্রফেশনাল লাইফে হাজব্যান্ড-ওয়াইফের সমানতালে এগিয়ে যাওয়া; আর এন্ট্রাপ্রেনিউরের মাথায় উঁকি দেয় ডে কেয়ার সেন্টারের আইডিয়া।’ অর্থাৎ মানুষ যেখানে সমস্যার মুখোমুখি হয়, উদ্যোক্তা সেখানে খোঁজেন নতুন ব্যবসার সম্ভাবনা। শুধু যে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য থাকে তা নয়, জীবনকে সহজ করার উদ্দেশ্যও থাকে এর পেছনে। ভোজ্যতেলের মান নিয়ে মানুষের মনে যে বিরাট আস্থাহীনতা বিরাজমান, সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তার মনে এটাই বেশি কাজ করেছে বলে মনে হয়।

কথায় বলে, মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের ফলে ব্যবসার প্রসার ঘটে। উদ্যোগ যত ছোট বা বড়ই হোক, তা অর্জন করতে সময় লাগে। সত্যিকার অর্থেই সৎ ব্যবসায়ীরা গ্রাহকের আস্থা হারাতে চান না। কিন্তু অবিশ্বাসে কী হয়? এর উত্তরে কেউ কেউ হয়তো বলবেন, ব্যবসা বিনষ্ট হয়। প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়ে। তবে উল্লিখিত ঘটনা থেকে বোঝা যায়, মানুষের আস্থাহীনতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তৈরি করে নতুন ব্যবসার সুযোগ। সত্যিকার অর্থেই যারা উদ্যোক্তা এ ক্ষেত্রগুলো কেবল তাদের চোখে পড়ে। শুধু এটি নয়, দেশে এরকম আরও অনেক ক্ষেত্র আছে, যেগুলোয় উদ্যোগ নিয়ে ভালো কিছু করা সম্ভব। ব্যতিক্রমী এ কাজগুলো করে আর্থিক সচ্ছলতা লাভের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা পাওয়াও যায়।

বলা ভালো, ব্যাংকগুলোও এখন এ ধরনের ব্যতিক্রমী ও ক্ষুদ্র উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছে। নতুন উদ্যোক্তা তৈরিকেও নিজেদের অর্জন হিসেবে দেখছে। এর পেছনে ভিন্ন কারণও আছে। প্রতি মাসে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও নারী উদ্যোক্তাবিষয়ক যে বিবরণী বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পেশ করতে হয়, তাতে নতুন উদ্যোক্তা কতজন, সে হিসাব দেখাতে হয় আলাদাভাবে। সে বিবেচনায় বলা যায় নিজেদের পারফরম্যান্সের জন্যই ব্যাংকগুলো স্বাগত জানাচ্ছে এমন উদ্যোগকে। আমি অবশ্য বিষয়টি দেখি ভিন্নভাবে। ব্যক্তির ছোটখাটো উদ্যোগ দাঁড়িয়ে গেলে একটি পরিবার সচ্ছল হয়। আর নতুন কোনো উদ্যোগ সফলভাবে পরিচালিত হলে সেটা নিয়ে অন্যদের মনেও সৃষ্টি হয় আগ্রহ। তাতে যদি যুক্ত থাকে মানুষের কল্যাণ উদ্যোক্তার জন্য সেটা যেমন গর্বের, তাতে পুঁজি সহায়তা জোগানোর প্রক্রিয়ায় থাকতে পারা ব্যাংকারের জন্যও তা হয়ে ওঠে আনন্দের।

 

লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা

[email protected]