ইসমাইল জাবিউল্লাহ:কৃষি খাতে মধ্যস্বত্বভোগী (গরফফষবসবহ) বলতে তাদের বোঝায় যারা পণ্য কৃষক উৎপাদন করার পর থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর মধ্যবর্তী এই সময়টুকুতে যারা জড়িত থাকে। এদেশের কৃষিতে শব্দটি খুবই নেতিবাচক। তাদের এই কর্মকাণ্ডের ফলে একদিকে যেমন কৃষকরা ফসলের আশানুরূপ দাম পান না, তেমনি ভোক্তাদের অতিরিক্ত মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে হয় দিতে হয় বাড়তি অর্থ। অথচ যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে উৎপাদিত হয় কৃষিদ্রব্য। তারাই বঞ্চিত হয় নিজের পণ্যের প্রাপ্য দাম থেকে। খুচরা বাজারে পণ্য আসে কয়েকজনের হাত বদলের মাধ্যমে। ফলে ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে দাম। সর্বশেষ সাধারণ ক্রেতাকে অধিক মুদ্রায় পণ্যদ্রব্য ক্রয় করতে হয়।
মধ্যস্বত্বভোগীরা স্বল্প দামে পণ্য দ্রব্য কৃষকের কাছ থেকে ক্রয় করে সেগুলো ঢাকা ও অন্যান্য শহরে এনে কয়েকগুণ বেশি দাম বিক্রি করে। ফলে তারা রাতারাতি ধনী হচ্ছে, অন্যদিকে যে কৃষক হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে এসব ফসল উৎপাদন করেন তারা দাম পান নামমাত্র। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কৃষক তার খরচ ওঠাতে হিমশিম খেয়ে যান।
এর বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশের সার্বিক উৎপাদন ব্যবস্থায়।
যখন একজন কৃষক তারা উৎপন্ন ফসল বিক্রি করে যদি উৎপাদিত ফসলের ব্যয় মেটাতে না পারেন তাহলে পরবর্তী ওই ফসল উৎপাদন আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন বন্ধ করে দেয় অথবা উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। যার কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কমে যায়। কিন্তু ভোক্তার চাহিদা আগের মতোই থাকে; ফলে বাজারে পর্যাপ্ত জোগান না থাকায় দ্রব্যের দাম অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে যায়। ফলে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়। দুর্বিষহ অবস্থায় পতিত হয় নি¤œ মধ্যবৃত্ত শ্রেণির মানুষ। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে না পেরে সরকারকে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয়। ফলে আমদানি ও রপ্তানি মধ্যে ব্যবধান বেড়ে যায়। যে কারণে বৈদেশিক রিজার্ভ পরিমাণও কমতে থাকে।
প্রায়ই পত্রিকা কিংবা খবরে শোনা যায় ভরা মৌসুমে কৃষক পণ্যের আশানুরূপ দাম পান না। কিছুদিন আগেও একটি খবরে দেখলাম লাউ এবং ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে অথচ ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা শহরে দাম প্রতিটি লাউ ৪০ থেকে ৫০ টাকা। ফুলকপি প্রতিটি ২০ থেকে ৩০ টাকা। কিন্তু ওই কৃষকদের প্রতিটি লাউ ফুলকপি উৎপাদন খরচ লেগেছে বিক্রির টাকার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা। বর্তমান বাজারে লক্ষ্য করুন এক কেজি টমেটোর দাম ৩০ থেকে ৩৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে অথচ সংবাদমাধ্যমর কল্যাণে জানতে পারলাম কৃষক প্রতি কেজি টমেটো ২ থেকে ৩ টাকা করে বিক্রি করছেন। কোথায় কোথায় বিক্রি না করতে পেরে ভাগাড়ে ফেলে দিচ্ছে।
এর পেছনে অন্যতম কারণ, হলো এসব মধ্যস্বত্বভোগীরা সিন্ডিকেট মাধ্যমে দ্রব্যের দাম কমে কেনার জন্য ভরা মৌসুমে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে পণ্য ক্রয় করে যে কারণে জোগান বেড়ে যায়; ফলে কৃষক কম দামে পণ্য বিক্রি করতে একপ্রকার বাধ্য হন।
কম দামে কিনে তারা সেসব পণ্য সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি করে না সেগুলো সংরক্ষণ করে যখন মৌসুম শেষ হয়ে যায়, তখন ক্রয় করা দাম থেকে কয়েকগুণ বেশি দামে ভোক্তার কাছে বিক্রি করে। যেমন মরিচের মৌসুমে এক কেজি শুকনো মরিচের দাম ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা কিন্তু এখন বাজারে এক কেজি মরিচের দাম ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা খুচরা বাজারে আরও বেশি। ফলাফল কী হলো কৃষক এবং ভোক্তা দুজনেই আর্থিকভাবে ক্ষতি হলো মাঝখানে দিয়ে এসব মধ্যস্বত্বভোগীরা বিপুল পরিমাণ অর্থ পকেটে নিয়ে নিল। তাদের এই নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ফলে চামড়া শিল্প আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। সবচেয়ে বড় পরিতাপের বিষয় হলো, কৃষিতান্ত্রিক বাংলাদেশে কৃষকদের ভাগ্য নিয়ে খেলে যাচ্ছে সমাজের একটা বিশেষ শ্রেণি অথচ এ ব্যাপারে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত খুব কমসংখ্যক মানুষ কথা বলে কিংবা সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে।
আমরা যতই শিল্প খাত কিংবা পর্যটন খাতকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন জন্য আবশ্যক ভাবি না কেন। কৃষি খাতকে তার থেকেও বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে। গত করোনা কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের জন্য নজির স্থাপন করে গেছে সেটা হলো শিল্প খাত যে কোনো সময় মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। যেমনটি আমাদের দেশি হয়েছে এবং হচ্ছে। অসংখ্য মানুষ চাকরিচ্যুত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলঙ্কা পর্যটন খাতকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিতে গিয়ে রীতিমতো দেউলিয়া হয়ে গেছে। তাই আমাদের কৃষি খাতকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
এখন প্রশ্ন হলো তাদের হাত থেকে কৃষক, ভোক্তা সর্বোপরি দেশের কৃষি খাতকে কীভাবে বাঁচানো যাবে? এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে হবে সরকারকে। পাশাপাশি বড় বড় কোম্পানিগুলোও ভূমিকা রাখতে পারে। তারা বড় পরিসরে বিনিয়োগ করে সরাসরি কৃষক থেকে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে পারে তাহলে কৃষকরা ন্যায্য দাম পেতে পারে। সম্প্রতি শরীয়তপুরের জাজিরাতে দেখা গেছে, রপ্তানিকারক কোম্পানি সরাসরি কৃষক থেকে পণ্য ক্রয় করে সেগুলো বিদেশে রপ্তানি করেছে এবং কৃষকদের কাছ থেকে বাজারের স্বাভাবিক দাম থেকে কিছু বেশি দিয়ে ক্রয় করেছে; ফলে কৃষকরা সন্তুষ্ট সেই সঙ্গে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানও খুশি।
এছাড়া সরকার কৃষকদের একজোট করে কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী সরাসরি খোলাবাজারে বাজারজাত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।
পাশাপাশি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণ কোল্ডস্টোরেজ ব্যবস্থা করতে পারে। তাহলে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য সেখানে সংরক্ষণ করে পরবর্তী সময়ে বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে।
সেই সঙ্গে কৃষকদের ফসল শহরে বাজারজাত করার জন্য সরকারিভাবে পরিবহনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে এবং খরচ বাবদ কৃষক থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নেবে।
যার দরুন কৃষক ন্যায্য মূূল্য পাবে। তাহলে একদিকে কৃষক দিন দিন উৎপাদন বাড়িয়ে দেবে, অনাবাদি জমি অবশিষ্ট থাকবে না। অন্যদিকে ক্রেতারা সুলভমূল্যে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে পারবে।
সেই সঙ্গে ধান বা গম ক্রয় কোনো দালালের মাধ্যমে না কিনা সরকারি উদ্যোগে ক্রয় করতে হবে তাহলে কৃষকরা ফসলের পর্যাপ্ত দাম পাবে। এছাড়া ভরা মৌসুমে যেন বাইরে দেশ থেকে কোনো কোম্পানি পণ্যসামগ্রী আমদানি না করতে পারে, সেদিকেও সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
দিনশেষে এটাই মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে কৃষিপ্রধান দেশে কৃষকের ভাগ্যোন্নয়ন মাধ্যমেই দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে কৃষক বাঁচলে বাঁচবে দেশ।
তাই আমাদের কৃষি খাত সামনের দিকে সফলভাবে এগিয়ে নিতে এসব অসাধু মধ্যস্বভোগীদের লাগাম টেনে ধরতে হবে। তবেই প্রকৃত সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
শিক্ষার্থী
আইন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়