প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

মর্যাদা সংকটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের আর্থিক খাতের একটি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক। রাষ্ট্রপতির আদেশবলে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যাত্রা শুরু ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সম্প্রতি কিছু ক্ষেত্রে এ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা মর্যাদা সংকটে ভুগছেন বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করেছে অন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মতো করে। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার বলে বাংলাদেশ ব্যাংককে শুধু ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক’ হিসেবেই সংজ্ঞায়ন করা যায়। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যে কারণে অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একই কাতারে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত নয়। এ অবনমন নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থানকে দুর্বল করছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের সভাপতি এইচএম দেলোয়ার হোসাইন দাবি-দাওয়া কমিয়ে দেওয়ার ফলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে চলমান কিছু সুবিধা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের বিবেচনা করা হচ্ছে অন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে। এটা চলতে থাকলে আমরা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে কাজই করতে পারবো না। তারা আমাদের পাত্তাই দেবে না।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো তো কোম্পানি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের পর্যায়ের না। তারা সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকের রেগুলেটর। রেগুলেটর হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্ট্যাটাস আলাদা। সুতরাং দুটিকে মিলিয়ে ফেললে তাদের মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে। তারা কাজ করতে গিয়েও হীনম্মন্যতায় ভুগবে।

তিনি বলেন, এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে যেসব সুবিধা তাদের দেওয়া হয়েছে, সেগুলো নিয়মিত করা উচিত, বাদ দিয়ে নয়। ২০ বছর ধরে একটি জিনিস পেয়ে আসছে, সেটাকে কেটে দিলে তো অবশ্যই খারাপ লাগবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে চালু থাকা বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে আনা হচ্ছে। বর্তমানে পাসপোর্ট অধিদফতর ও এনবিআরের ওয়েব পেজে বাংলাদেশ ব্যাংককে শুধু ‘ব্যাংক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যে কারণে কর্মকর্তারা অফিসিয়াল পাসপোর্টের সুবিধা পাচ্ছেন না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও গবেষণা কোষ থেকে প্রকাশিত সরকারি সংস্থাসগুলোর নাম ও যোগাযোগের ঠিকানা ২০১৬ শীর্ষক পুস্তকের ৩১ নম্বর পৃষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডারের পরিপন্থী। এতে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যতটুকু অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে, এর চেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির সম্মানের। সোনালী, রূপালী, জনতা, অগ্রণী অফিসিয়াল পাসপোর্ট পেলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা তা পাচ্ছেন না। আবার স্বায়ত্তশাসিত হয়েও প্রতিষ্ঠানটি নিয়ন্ত্রণাধীন।

অভিযোগ উঠেছে, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধাগুলো বাতিল করা হচ্ছে। আগে  বাংলাদেশ ব্যাংকের নবীন কর্মকর্তাদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে ভালো ফলের (৮০ শতাংশ ও তদূর্ধ্ব) ওপর বিশেষ ইনক্রিমেন্ট সুবিধা দেওয়া হতো। এ ইনক্রিমেন্টটি বাংলাদেশ ব্যাংকে মেধাবি কর্মকর্তাদের ধরে রাখতে সহায়তা করতো, যা বাংলাদেশ ব্যাংক স্টাফ রেগুলেটস অ্যাক্ট-২০০৩-এর আর্টিকেল ৮ এর (vi) ধারা বলে দেওয়া হতো। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তা প্রকল্প কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের দুজন হিউম্যান রিসোর্স কনসালট্যান্টের সুপারিশক্রমে প্রতি তিন বছরে একবার মূল বেতনের দেড়গুণ হারে শান্তি বিনোদন ভাতা দেওয়া হতো।  যদিও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ ভাতা তাদের মূল বেতনের সমান পেয়ে থাকেন। সম্প্রতি এ ভাতা কমিয়ে মূল বেতনের সমান করা হয়েছে। অর্থাৎ এখানেও অন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা নিজ উদ্যোগে উচ্চশিক্ষার জন্য কোনো বৈদেশিক বৃত্তি পেলে পূর্ণ বেতনে প্রেষণ পেয়ে আসছিলেন। এ বিষয়ে সরকারি গেজেটও রয়েছে। কিন্তু গভর্নর দায়িত্ব গ্রহণের পর তা বাতিল করেছেন।  বর্তমানে নিজ উদ্যোগে প্রাপ্ত পূর্ণবৃত্তির ক্ষেত্রেও প্রেষণ মঞ্জুর না করে অর্ধ-বেতন বা বিনা বেতনে ছুটি মঞ্জুর করা হচ্ছে। এতে কর্মকর্তারা উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন। সম্প্রতি নতুন বেতন স্কেল হওয়ার পর কর্মকর্তাদের ব্যাংক রেটে ঋণের সিলিং বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলেও তা বাতিল করা হয়েছে। এটি নিয়েও ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা। পে-স্কেলে উল্লেখ করা সুবিধাদি পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হলেও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের (নবম ও তদূর্ধ্ব) বর্তমানে চলমান প্রেষণ অব্যাহত থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ‘বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’তে প্রশিক্ষণকাজে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের প্রেষণ ভাতা হিসেবে দেওয়া সুবিধা কেটে নেওয়া হয়েছে। যদিও তা পে-স্কেলেও ২৮ ধারায় বহাল রাখার কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শত শত কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা বিসিএস ক্যাডার হিসেবে চাকরি পেয়েও সেখানে যোগদান করেননি তারা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরিকে বেছে নিয়েছেন তাদের ক্যারিয়ার হিসেবে। কিন্তু তারা এখন মনে করছেন, এভাবে দিন দিন যদি তাদের মর্যাদার দিক দিয়ে ছোট করা হয় তাহলে মেধাবীরা এখানে আসবে না।

বহু দিনের দাবি একটি আলাদা বেতন স্কেল। এর আগের সব গভর্নরই এ দাবির পক্ষে কথা বলেছিলেন। ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ বিশ্বেও বেশিরভাগ দেশই তাদেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল তৈরি করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার-১৯৭২ (সংশোধিত বাংলাদেশ ব্যাংক অ্যাক্ট ২০০৩) এ বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ‘সেলারি অ্যান্ড কমপেনসেশন প্যাকেজ’ নির্ধারণে ‘স্কিল অ্যান্ড কম্পিটেন্সি নিডেড ফর সেন্ট্রাল ব্যাংকিং’ বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। ১৯৭৩ সালে ঘোষিত প্রথম পে-স্কেল হতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণকারী বাংলাদেশ ব্যাংককে অন্যান্য ব্যাংকের মতো একটি সাধারণ ব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করে বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হচ্ছে। সর্বশেষ বেতন স্কেলেও এটাই করা হয়েছে।