মিলন মিয়া : বিশ্বের শীর্ষ দূষিত শহরগুলোর তালিকায় বরাবরই প্রথম দিকে অবস্থান করে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, যানজটসহ নানা ধরনের দূষণের শিকার হচ্ছে এই ঢাকা। জনসংখ্যার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় এবং বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম শহর হলো ঢাকা। তাই এই বিপুলসংখ্যক মানুষের বসবাসের জন্য রাজধানীর ওপর চাপও অত্যধিক। এর ফলে দৈনন্দিন জীবনে মানুষকে নানারকম ভোগান্তির শিকার হতে হয়। এসব ভোগান্তির মধ্যে অন্যতম হলো শব্দদূষণ। শব্দদূষণকে বলা হয় অদৃশ্য দূষণ। শব্দদূষণ হলো মানুষের সহনশীলতার সীমা অতিক্রমকারী তীব্র ও অবাঞ্ছিত শব্দ, যা মানুষের স্বাস্থ্য ও মনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। অন্যভাবে বলা যায়, ৫০-৭০ ডিবি (ডেসিবেল) শব্দের মধ্যে মানুষ স্বস্তি বোধ করে, কিন্তু এর চেয়ে বেশি মাত্রার শব্দই শব্দদূষণ হিসেবে গণ্য হয়।
জাতিসংঘ পরিবেশ প্রোগ্রামের (ইউএনইপি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার গড় শব্দমাত্রা ১১৯ ডিবি। ৪০-৫০ ডেসিবেল শব্দ মানুষের জন্য সহনীয় এবং একটি মানক স্তর হিসেবে গণ্য করা হয়। ৭০ ডেসিবেলের বেশি শব্দ দীর্ঘ সময় ধরে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং ৮০ ডেসিবেলের বেশি শব্দ মানুষের কানের জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের ‘শব্দ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬’ অনুসারে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত বা এ-জাতীয় অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের চারপাশের ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে গণ্য হবে। এছাড়া এই বিধিমালাতে আরও বলা হয়েছে, নীরব এলাকায় দিনের বেলায় ৫০ ডিবি, রাতের বেলায় ৪০ ডিবি, আবাসিক এলাকায় দিনের বেলায় ৫৫ ডিবি, রাতের বেলায় ৪৫ ডিবি, মিশ্র এলাকায় দিনের বেলায় ৬০ ডিবি, রাতের বেলায় ৫০ ডিবি, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনের বেলায় ৭০ ডিবি, রাতের বেলায় ৬০ ডিবি এবং শিল্প এলাকায় দিনের বেলায় ৭৫ ডিবি ও রাতের বেলায় ৭০ ডিবি শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) ২০২২ সালে ঢাকায় শব্দদূষণের ওপর এক গবেষণা চালায়। ক্যাপস ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সড়কের মোট ৮২টি সংযোগ স্থানের শব্দের মাত্রা পরিমাপ করে। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার ৩৭টি এবং উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার ৪৫টি স্থান। গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে শব্দের তীব্রতা মান মাত্রা ছাড়িয়েছে। নগরের বিভিন্ন স্থানে সাধারণভাবে শব্দের গ্রহণযোগ্য মান মাত্রার থেকে প্রায় ১ দশমিক ৩ থেকে দুইগুণ বেশি শব্দ পাওয়া গেছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় শব্দের গড় মাত্রা পাওয়া গেছে ৭৬ দশমিক ৮০ ডিবি। যে তিনটি সড়কের সংযোগস্থলে সর্বোচ্চ মাত্রার শব্দদূষণ পাওয়া গেছে, সেগুলো হলো নিউমার্কেট নীলক্ষেত মোড়, নয়া পল্টন মোড় এবং প্রেস ক্লাব মোড়। সেখানে শব্দদূষণের মাত্রা যথাক্রমে ১০০ দশমিক ৬৫ ডিবি, ৯২ দশমিক ২২ ডিবি এবং ৯০ দশমিক ০৩ ডিবি। গবেষণায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে শব্দের গড় মাত্রা পাওয়া গেছে ৮০ দশমিক ৫৬ ডিবি। যে তিনটি সড়কের সংযোগস্থলে সর্বোচ্চ মাত্রার শব্দদূষণ পাওয়া গেছে, সেগুলো হলো মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড মোড়, শিয়া মসজিদ মোড় এবং মাসকট প্লাজা মোড়। এসব স্থানে শব্দদূষণের মাত্রা যথাক্রমে ৯৯ দশমিক ৭৭ ডিবি, ৯৩ দশমিক ০৫ ডিবি এবং ৯০ দশমিক ২৭ ডিবি। ‘Frontiers in Public Health’ ২০২৪ সালে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় শব্দদূষণ এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর তার প্রভাব নিয়ে এক জরিপ চালায়। এতে বলা হয়, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর অফিসের ঘণ্টা শেষে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ ঘটে। এছাড়া ঢাকার আরও যেসব এলাকায় শব্দের তীব্রতা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি সেগুলো হলো আব্দুল্লাহপুর, গুলশান-২, তেজগাঁও, কাওরান বাজার, ফার্মগেট, মিরপুর-১০, মহাখালী বাস টার্মিনাল, গাবতলী, গুলিস্তান, মতিঝিল, মৌচাক ও মালিবাগ এবং সচিবালয় এলাকা।
ঢাকা শহরে যেসব কারণে শব্দদূষণ হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম কারণগুলো হলো— মোটরগাড়ি, বাস, ট্রাক, মোটর সাইকেল প্রভৃতির অযথা হর্ন বাজানো ও সাইলেন্সার পরিবর্তনের কারণে শব্দদূষণ হওয়া। ভবন, সেতু ও রাস্তাঘাট নির্মাণে ব্যবহূত ভারী যন্ত্রপাতি, যেমন ড্রিল মেশিন, কংক্রিট মিক্সার প্রভৃতি দ্বারা শব্দদূষণ হচ্ছে। কারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মেশিন, জেনারেটর, কমেপ্রসার প্রভৃতি থেকে অবিরাম শব্দদূষণ ঘটছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বিয়ে, মেলা বা রাজনৈতিক সভায় অতিরিক্ত লাউডস্পিকার ও সাউন্ড সিস্টেমের অপব্যবহারের ফলে শব্দদূষণ হচ্ছে। জেনারেটর, এয়ার কন্ডিশনার ও অন্যান্য যান্ত্রিক যন্ত্রপাতি বিশেষ করে আবাসিক এলাকায় এগুলো শব্দদূষণের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। বিমানবন্দরে বিমান ওঠানামা ও ট্রেনের ইঞ্জিনের শব্দের কারণে আশেপাশের এলাকায় শব্দ দূষিত হচ্ছে। জনসমাগম বা সামাজিক কার্যক্রমে অতিরিক্ত মাইক, ব্যান্ড, আতশবাজি বা উৎসবের কারণে শব্দদূষণ হচ্ছে।
শব্দদূষণ মানুষ, সমাজ ও পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত শব্দে মানুষ বিরক্ত, উত্তেজিত ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। নিয়মিত শব্দদূষণের মধ্যে বসবাস করলে উদ্বেগ, হতাশা ও নিদ্রাহীনতা দেখা দেয়। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মনোযোগ নষ্ট হয়, কাজের উৎপাদনশীলতা কমে যায়। দীর্ঘ সময় উচ্চ শব্দে থাকলে শ্রবণশক্তি ক্ষয় হয়। হঠাৎ জোরে শব্দ হলে কর্ণপটহ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। রক্তচাপ বৃদ্ধি, হূৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া এবং হূদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। শব্দদূষণ শিশু ও গর্ভবতী নারীদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত শব্দ শিশুর মানসিক বিকাশ ব্যাহত করে। গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে অকাল সন্তান জন্ম ও শিশুর ওজন কম হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। রাতে শব্দদূষণ থাকলে ঘুম ভেঙে যায়, ফলে মানসিক চাপ, মাথাব্যথা ও ক্লান্তি তৈরি হয়। দীর্ঘ মেয়াদে ঘুমের ঘাটতি থেকে স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ কমে যায়। শব্দদূষণের কারণে মানুষের সহনশীলতা ও সামাজিক আচরণ পরিবর্তিত হয়। প্রাণীরা দিগ্ভ্রান্ত হয়, পাখিরা বাসা ছেড়ে চলে যায়, বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়, শ্রমিকদের মনোযোগ নষ্ট হয়ে উৎপাদন কমে যায় এবং স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত চিকিৎসা ব্যয় বাড়ে।
তবে বিশ্বের অনেক দেশ শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে। সুইডেন শহর পরিকল্পনায় শব্দ নিয়ন্ত্রণকে বাধ্যতামূলক করেছে। রাস্তায় ‘নয়েজ রিডিউসিং পেভমেন্ট’ ব্যবহার করে। গণপরিবহন ও যানবাহনে শব্দসীমা কঠোরভাবে মানা হয়। জাপানে ‘Noise Regulation Law’ (১৯৬৮ সাল থেকে) কঠোরভাবে কার্যকর। বিমানবন্দর ও শিল্প এলাকায় বিশেষ ‘সাউন্ড ব্যারিয়ার’ তৈরি করেছে। রাতের বেলায় গাড়ি ও মোটরসাইকেলের শব্দের জন্য আলাদা সীমা নির্ধারণ করেছে। জার্মানিতে ‘Federal Immission Control Act’ অনুযায়ী শব্দের মাত্রা নির্দিষ্ট। রেললাইন, হাইওয়ে ও আবাসিক এলাকায় ‘Noise Mapping’ করে শব্দ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বৈদ্যুতিক গাড়ি ও সাইলেন্ট জোন নীতি প্রচলন করেছে। সিঙ্গাপুরে শব্দ নিয়ন্ত্রণে কড়া আইন ও জরিমানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নির্মাণকাজ নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে করলে উচ্চ জরিমানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নাগরিকদের অভিযোগ নেওয়ার জন্য Noise Complaint App চালু আছে। সুইজারল্যান্ডে পরিবেশবান্ধব নগর পরিকল্পনা, ঘর বাড়িতে সাউন্ডপ্রুফ জানালা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে অনেক স্থানে। রেল ও ট্রাফিক শব্দ কমাতে বিশেষ ‘Noise Barriers’ বসানো হয়েছে। নরওয়েতে সরকারি প্রকল্পের আগে ‘Noise Impact Assessment’ করা হয়। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করে শব্দদূষণ ৩০% পর্যন্ত কমিয়েছে। সফল দেশগুলোতে তিনটি বিষয় সাধারণভাবে দেখা যায়, শক্তিশালী আইন ও তার বাস্তব প্রয়োগ, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, নাগরিকদের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ। তাই শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আমাদের দেশের জনগণ, রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। ‘শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬’ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। বিধিমালাতে যে আইনের উল্লেখ করা হয়েছে, তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। অপ্রয়োজনে হর্ন বাজালে জরিমানা করতে হবে। পুরোনো ও ত্রুটিপূর্ণ সাইলেন্সারযুক্ত গাড়ি রাস্তায় চলতে দেয়া যাবে না। বাস, ট্রাক ও মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য যানবাহনে যেন হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহূত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আবাসিক এলাকায় নির্মাণকাজ শুধু নির্দিষ্ট সময়ের (যেমন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত) মধ্যে করতে হবে। শব্দ কমাতে সাউন্ড ব্যারিয়ার বা সাইলেন্ট মেশিন ব্যবহার করা যেতে পারে। উৎসব, সভা বা বিবাহ অনুষ্ঠানে সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহারে অনুমতি ও সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে। রাস্তার পাশে ও জনবহুল এলাকায় গাছ লাগালে শব্দ শোষণ হয়, ফলে শব্দদূষণ কিছুটা কমে। স্কুল, কলেজ ও মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষকে শব্দদূষণের ক্ষতি ও নিয়ন্ত্রণের উপায় সম্পর্কে জানাতে হবে। ‘নো হর্ন জোন’ এলাকা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে। হাসপাতাল, স্কুল, আদালত প্রভৃতি এলাকায় ‘নিঃশব্দ এলাকা’ ঘোষণা এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব উদ্যোগ ও নিয়মগুলো যথাযথভাবে মেনে চললেই আমরা সুন্দর, বসবাস-উপযোগী এবং শব্দদূষণমুক্ত একটা শহর গড়ে তুলতে পারব।
ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা কলেজ
প্রিন্ট করুন






Discussion about this post