আলমগীর হোসেন: বগুড়ার মহাস্থানহাট উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও ঐতিহাসিক কাঁচাসবজির বাজার। আশপাশের ৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকার কৃষকদের পছন্দের সবজির হাট এটি। এ অঞ্চলের উৎপাদিত আলু, কপি, মরিচ, মূলা, বেগুন ও লাউসহ যাবতীয় সবজির বেচাকেনা হয় এখানে। প্রতি হাটে প্রায় পাঁচশ মণ সবজি বিক্রি হয়ে থাকে, যা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে চলে যায়।
মহাস্থানহাটের নামকরণ
রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের পাশে বগুড়া জেলা শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তরে হজরত শাহ সুলতান বলখীর (রহ.) পুণ্ড্রভূমি হিসেবে পরিচিত ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়ের নাম অনুসারে এ হাটের নামকরণ করা হয়েছে মহাস্থানহাট। সপ্তাহে বুধবার ও শনিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এ মহাস্থানহাটে সবজি বেচাকেনা। বিশেষ করে, শীতকালীন সময়ে জমজমাট এখানকার সবজির বাজার।
পরিবহন ব্যবস্থা
ভ্যান-রিকশা, শ্যালোমেশিন চালিত ভটভটি, পিকআপ ভ্যান বা ছোট ট্রাকে করে চাষিরা হাটে নিয়ে আসেন সবজি। শাকসবজি কেনার জন্য বগুড়া ছাড়াও ঢাকা, কুমিল্লা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলার পাইকারি ব্যবসায়ীরা বাস-ট্রেনযোগে চলে আসেন এখানে।
যা পাওয়া যায়
আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, হাইব্রিড, লম্বা বেগুন, গোল বেগুন, শসা, পটোল, করলা, কাঁচামরিচ, পেঁপে, বরবটি, চিচিঙ্গা, কচুমুখী ও জালিকুমড়া কেনাবেচা হয়ে থাকে। মহাস্থানহাটের পাশের এলাকায় গোলআলু, মিষ্টিআলু ও মিষ্টি কুমড়া ভালো উৎপাদন হয়ে থাকে। এসব সবজি হাটের ঐতিহ্য বাড়িয়ে দিয়েছে। আর উত্তরের জেলাগুলোতে গোলআলু, মিষ্টিআলু, মিষ্টি কুমড়ার চাহিদাও ব্যাপক। অন্যান্য সবজির পাশাপাশি মিষ্টিআলু এবং মিষ্টি কুমড়া নেওয়ার জন্য মহাস্থানহাটে আসতেই হয়। শাকসবজির জন্য এত বড় হাট উত্তরাঞ্চলের আর কোথাও বসে না।
চাষিদের কথা
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে জমিতে সবজি চাষ করেন বগুড়ার কৃষকরা। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে তা বিক্রি শুরু হয়। চলে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সবজি বিক্রির কথা চিন্তা করলে প্রথমেই কৃষকের পছন্দের তালিকায় আসে মহাস্থানহাটের নাম। দামও পাওয়া যায় ভালো। উৎপাদিত সবজি বিক্রি নিয়ে তাদের খুব একটা চিন্তা করতে হয় না।
জেলার বাইরে থেকে পাইকারি-ব্যবসায়ীরা আসার কারণে সবজিচাষিরা সাধারণত হাটবারেই বেশি শাকসবজির সমারোহ ঘটান। তুলনামূলক দাম ভালো পাওয়ায় চাষিদের চোখে-মুখেও থাকে তৃপ্তির ছাপ। মহাস্থানহাটে আসা সবজিচাষি মোজাম্মেল হোসেন মণ্ডল জানান, উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম সবজির হাট হওয়ায় যে কোনো সবজি এখানে বিক্রি করতে আসি। এখানে দূর-দূরান্ত থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা আসেন, সে কারণে দাম অনেক সময় ভালো পাওয়া যায়। কোনো কারণে দূরের পাইকারি ব্যবসায়ীরা না এলে সব সবজির দাম মোটা অঙ্কে কমে যায়।
সবজিচাষি জয়নাল আবেদীন জানান, মূলা ও শিম চাষাবাদ করেছিলাম, ফলন ভালো হয়েছে এবং বর্তমান বাজারদর ভালো। ফলে এ দুটি ফসলে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু অনেক সময় হঠাৎ সবজির দাম কমে গেলে তখন লাভের মুখ দেখা যায় না।
সবজিচাষি নজরুল ইসলাম ও জিল্লুর রহমান জানান, অন্যান্য ফসলের চেয়ে মূলা, গাজর, শসাসহ অন্যান্য সবজি চাষাবাদ করতে সময় ও খরচ কম হয়। স্বল্প সময়ে সবজি উৎপাদন হওয়ায় অনেক সময় আগাম বাজার পাওয়া যায়। আগাম সবজি বাজারে তুললে দাম অনেকটা চড়া পাওয়া যায়। সেজন্য প্রায় বছরজুড়ে এসব সবজি চাষ করে থাকি।
আবদুল কুদ্দুস জানান, সবজি চাষ করে এ অঞ্চলের অনেক কৃষকের ভাগ্যপরিবর্তন হয়েছে। এখানকার আগে অন্য কোনো এলাকার চাষিরা আগাম মূলা, গোলআলু কিংবা বেগুন বাজারের আনতে পারে না বলেও দাবি তার।
ক্রেতাদের ভাবনা
সুবিধার পাশাপাশি অভিযোগও আছে ক্রেতাদের। একই বাজারে দুই ধরনের দাম নিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের রয়েছে মনোকষ্ট। তাদের অভিযোগ, পাইকারি বাজারের সঙ্গে খুচরা বাজারের দামের তফাৎ দ্বিগুণেরও বেশি। এ হাটেই সবজির পাইকারি বাজারের সঙ্গে খুচরা বাজারের কোনো মিল নেই। মহাস্থানহাটে আসা খুচরা ক্রেতা রেজাদুল হক রেজা জানান, প্রতি কেজি মূলা পাইকারি বাজারে ২০-২২ টাকায় বিক্রি হলেও তা খুচরা বাজারে ৩০-৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এমনিভাবে ফুলকপি, পাতাকপি, বেগুনসহ সব সবজিও খুচরা পর্যায়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি করা হয়। এটা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। যার যেমন খুশি দামে সবজি বিক্রি করছেন। এতে আমরা সাধারণ ভোক্তারা বেশি দামে সবজি কিনতে বাধ্য হচ্ছি।
কেমন আছেন আড়তদার
পাইকারি সবজি ব্যবসায়ীদের কেনাকাটায় সহযোগিতা করতে হাটসংলগ্ন মহাসড়কের পাশে সবজি, ফল, বীজের আড়ত খুলে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। মহাস্থানহাটের আড়তদার মেসার্স মোস্তা ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তা জানান, ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ বিভিন্ন বড় শহরের পাইকাররা এখান থেকে শাকসবজি কিনে নিয়ে যান।’ তার দাবি, তার আড়ত থেকে প্রতিদিন প্রায় দেড়শ’ মণ শাকসবজি বিক্রি হয়ে থাকে। দূরের পাইকারি সবজি ব্যবসায়ীদের পছন্দের সবজি দিয়ে সহযোগিতার করার কথাও জানান তিনি।
মহাস্থানহাট কাঁচাপাকা মাল আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম জানান, সবজির পাইকারি ও খুচরা বাজারের দামে পার্থক্য থাকবেই। এ হাটে পাইকারি কিনে অনেকেই খুচরা বিক্রি করছে। তবে খুচরা পর্যায়ে যে দামে বিক্রি হয় তা অনেক সময় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতি বাজারদর স্বাভাবিক রাখতে সরকারি কর্মকর্তাদের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।
ব্যবসায়ীদের খোঁজ-খবর
দূরের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পণ্যবাহী ট্রাকে একাধিক স্থানে চাঁদাবাজি ও সবজি নষ্ট হওয়ার কারণে তাদের সবজির দাম বেড়ে যায়। রাজধানী ঢাকার কারওয়ানবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মহাতাব আলী জানান, প্রতিদিন মহাস্থানহাটের শাকসবজি চন্দ্রা, গাজীপুর, কারওয়ানবাজারসহ রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করে থাকি। এখন প্রতিদিন এক ট্রাক করে কয়েক ধরনের সবজি এসব এলাকায় বিক্রি করছি। সবজির দাম একটু কমলে প্রতিদিন ২-৩ ট্রাক মাল সরবরাহ করা হবে।
সিলেটের সবচেয়ে বড় কাঁচা সবজির ব্যবসায়ী মাসুদ জানান, মহাস্থানহাট থেকে সপ্তাহের প্রায় প্রত্যক দিনই বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি সিলেট বাজারে যায়। আমরা হাটে যাই না। ওখানকার আড়তদার আসেন, তারা আমাদের পছন্দমতো বা চাহিদা অনুযায়ী সবজি কিনে ট্রাকভর্তি করে পাঠিয়ে দেন। প্রতিদিন সিলেটের বাজারে দেড়শতাধিক কাঁচা সবজি আসছে। বর্তমানে শীতকালীন সবজির দাম একটু বেশি, দাম
কমলে সবজি আনার পরিমাণ বেড়ে যাবে।
কেন বেশি দাম
প্রচুর সবজি উৎপাদনের পরেও দামের বাজার চড়া মহাস্থানহাটের। কেন দাম বেশি তা জানা গেল চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকার ব্যবসায়ী মেসার্স আজিজ ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী নসু মিয়ার কাছ থেকে। তিনি বলেন, মহাসড়কে পণ্যবাহী ট্রাকে অতিরিক্ত চাঁদাবাজির প্রভাব পড়ে এসব পণ্যের ওপর। তাই দূরের বাজারে সবজি বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। সবজির দাম বেশি হওয়ায় ২-৩ জন ব্যবসায়ী মিলে এক ট্রাক মাল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ইজারাদার যা বললেন
মহাস্থানহাট ইজাদার কমিটির সদস্য মো. আজমল হোসেন জানান, মহাস্থানহাটে প্রতিদিন কত টাকার সবজি বিক্রি হয়, এটা বলা না গেলেও প্রায় ৩০-৩৫ ট্রাক কাঁচা মালামাল দূর-দূরান্তে চলে যায়। এ হাটে দূরের ব্যবসায়ীদের বিশেষ নিরাপত্তা ও সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক প্রতুল চন্দ্র সরকার জানান, উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও ঐতিহাসিক কাঁচা সবজির এ হাট সমৃদ্ধ করেছে জেলার সবজিচাষিরাই। এখানকার সবজিচাষিরা এক জমিতে একই সঙ্গে দুই-তিন জাতের ফসল উৎপাদন করে। বৃষ্টিতে শীতকালীন আগাম সবজির (রবিশস্য) কোনো ক্ষতি হয়নি। বাজারেও নেই সবজির কোনো ঘাটতি। যদিও জেলায় এ বছর মোট সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৪৩ হাজার টন। কিন্তু আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।