এস এম রুবেল, কক্সবাজার: জলবায়ু পরিবর্তনে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পুরো বিশ্ব যেখানে নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে, সেখানে মহেশখালী দ্বীপের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষায় কোনো ভূমিকা নেই প্রশাসনের। যার কারণে প্রকাশ্যে প্যারাবন কেটে নির্মাণ করা হচ্ছে ঘের, পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করে বের করা হচ্ছে জমি আর গড়ে তোলা হচ্ছে বসতি, বনের গাছ কেটে উজাড় করা হচ্ছে বনাঞ্চল। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই দ্বীপটির পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হয়ে যাবে বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা।
কক্সবাজার জেলার উত্তর-পশ্চিম পাশে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা দ্বীপটির নাম মহেশখালী। এটিই বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ। পরে এখানে ছোট ছোট আরও কয়েকটি দ্বীপ জেগে উঠছে। ১৫০ বর্গমাইলের দ্বীপটি ১৯৫৪ সালে থানা এবং ১৯৮৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর উপজেলা ঘোষণা করা হয়। দ্বীপটিতে বর্তমানে ১টি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়নে প্রায় ৪ লাখ মানুষের বসবাস।
জীববৈচিত্র্যের এই দ্বীপে প্রকাশ্যে প্যারাবন, পাহাড় ও বনের গাছ কাটাসহ নানান পরিবেশবিধ্বংসী কাজ চলছে। কিন্তু সেই বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না উপজেলা প্রশাসন কিংবা বনবিভাগ। এছাড়া প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষিত সোনাদিয়া দ্বীপের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য গত ২৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে লিখিত আদেশ দিলেও তা দেড় মাসেও কার্যকর করেনি জেলা প্রশাসন কিংবা উপজেলা প্রশাসন।
এর আগেও ৬ জানুয়ারি অসাধু ব্যবসায়ীরা অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলে বহিরাগতদের রাত্রিযাপনের মাধ্যমে সোনাদিয়া দ্বীপের স্থলচর ও জলজ বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থল বিনষ্ট, রাতে আগুন জ্বালানো, সাউন্ডবক্স বাজানো, অনৈতিক কাজসহ বিভিন্ন পরিবেশবিধ্বংসী কাজ করে পরিবেশ বিনষ্ট করায়, সেসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের অনুরোধ জানিয়ে মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে চিঠি দেন মহেশখালী থানার ওসি প্রণব চৌধুরী। তারপরেও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি উপজেলা প্রশাসন। বরং আগের চেয়ে বেড়েছে সোনাদিয়া দ্বীপে পরিবেশবিধ্বংসী কাজ।
ছোট মহেশখালী, বড় মহেশখালী, শাপলাপুর, কালারমারছড়া ও হোয়ানক ইউনিয়নে দিনরাত পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করছে। এছাড়া বনের গাছ কেটে দেদার বিক্রি করা হচ্ছে। আর মহেশখালীর পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে এবং পূর্বে কোহেলিয়া নদীর পাড় ঘেঁষে প্যারাবন কেটে নির্মাণ করা হচ্ছে বিশাল বিশাল ঘের। পরিবেশবিধ্বংসী কাজ নিয়ে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরেও নিশ্চুপ উপজেলা প্রশাসন আর বনবিভাগ। আর তাতেই আরও বেশি জনবল নিয়ে পরিবেশবিধ্বংসী কাজে নেমে পড়েছে ভূমিদস্যু ও বনখেকোরা।
সূত্রে জানা গেছে, প্যারাবন, পাহাড় ও বন কাটার সঙ্গে জড়িত মহেশখালী দ্বীপের প্রভাবশালী কয়েকটি গ্রুপ। যাদের মধ্যে সরকারদলীয় রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিরাও জড়িত। মূলত তাদের সঙ্গে আঁতাত করেই নীরব ভূমিকায় রয়েছে প্রশাসন। এমনটি মনে করছেন স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে কথা হয় মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ ইয়াসিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্যারাবন, পাহাড় ও বন কাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া বা অভিযান চালানোর বিষয়টি আমার অধীনস্থ নয়। বিষয়টি দেখবে সংশ্লিষ্ট দপ্তর। যেমনÑ পরিবেশ অধিদপ্তর ও বনবিভাগ। তারা সহযোগিতা চাইলে আমি শুধু সহযোগিতা করতে পারি।’ প্যারাবন ও পাহাড় কাটার বিষয়ে ইতোমধ্যে পত্রিকায় নিউজ হয়েছে। এখনও কাজগুলো অব্যাহত রয়েছে। এই ক্ষেত্রে আপনি কোন ধরনের ব্যবস্থা নেবেন কিনা? এর উত্তরে ইউএনও জানান, সংশ্লিষ্ট দপ্তর সহযোগিতা না চাইলে আমার করণীয় কিছু নেই। খাস জমির মালিক সরকার। সে ক্ষেত্রে খাস জমি দখল করে অবৈধভাবে ঘের নির্মাণ করা হচ্ছে, সেই বিষয়ে আপনি কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন, এই প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘খাস জমি অহরহ দখল হচ্ছে এখানে। এছাড়া মহেশখালীর সব জমিই খাস। আমি মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ অভিযান চালাই।’
এদিকে মহেশখালী উপকূলীয় বনবিভাগের রেঞ্জ অফিসার এস এম আনিসুর রহমান জানান, তাদের পর্যাপ্ত জনবল নেই। তাই নানান সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অভিযান চালানোর সময় তারা পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের সহায়তা নেন।
অপরদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের মহেশখালী শাখার সাধারণ সম্পাদক আবু বক্কর জানান, মহেশখালীতে যে হারে পরিবেশ বিধ্বংসী কাজ চলছে, তা বন্ধে ইউএনও ও বনবিভাগের ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ। ইউএনও উপজেলার অভিভাবক। তিনি ও বনবিভাগ সক্রিয় ভূমিকা রাখলে ভূমিদস্যুরা নতুন নতুন প্যারাবন ও পাহাড় কাটতে
ভয় পেত।
কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সদস্য সচিব এইচ এম নজরুল ইসলাম জানান, প্যারাবন মহেশখালীর দ্বীপকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করে। পাহাড় ও প্যারাবন রক্ষা করা না গেলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে দ্বীপের মানুষের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। দ্রুত প্যারাবন ও পাহাড় কাটা বন্ধে সরকারকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।