প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

মহেশখালী দ্বীপে চলছে প্যারাবন কাটার মচ্ছব

কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে মানুষের জানমাল রক্ষায় ঢালের ভূমিকা পালন করে প্যারাবন। কিন্তু একটি প্রভাবশালী মহল এ বন কাটায় ঝুঁকিতে পড়ছে এ দ্বীপের চার লাখ মানুষ। এ বিষয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ প্রথম পর্ব

এসএম রুবেল, কক্সবাজার: কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল আঘাত হানে প্রলয়ঙ্করী এক ঘূর্ণিঝড়। সেই ঘূর্ণিঝড়ে মহেশখালী দ্বীপে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটে, যা উপকূলীয় মানুষের মনে এখনও দাগ কেটে আছে। স্বজন হারানোর বেদনায় দিনটিকে এখনও স্মরণ করে তারা। ঘূর্ণিঝড় থেকে দ্বীপাঞ্চলের মানুষকে রক্ষার জন্য ওই ঘূর্ণিঝড়ের পরপরই বেড়িবাঁধ তৈরি করা হয়। তারপর থেকে বেড়িবাঁধ ও তার বাইরে থাকা বিশাল আকৃতির প্যারাবনই এখানকার মানুষের জানমাল রক্ষায় পাহারাদারের ভূমিকা পালন করে আসছে। এর বাইরে বন বিভাগ কর্তৃক বিভিন্ন জায়গায় প্যারাবন সৃজন করা হয়।

পরে ২০০৩ সালে বিএনপি আমলে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের নেতারা মিলেমিশেই বেড়িবাঁধের বাইরে প্যারাবন কেটে ঘের নির্মাণের কাজ শুরু করে। এরপর ধারাবাহিকভাবে রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীরা প্যারাবন কেটে ও খাসজমি দখল করে অর্ধশতাধিক ঘের নির্মাণ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে ফেলেছে মহেশখালী দ্বীপকে। এরই মধ্যে প্যারাবন কেটে গত ছয় মাসে আরও দুটি নতুন ঘের নির্মাণের কাজ শুরু করেছে প্রভাবশালীরা। এর ফলে বর্ষাকালে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ঝুঁকিতে পড়েছে মহেশখালীর চার লাখ মানুষের জীবন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলার শাপলাপুর ইউনিয়নের মহেশখালী চ্যানেলের পাশে ঘটিভাঙ্গা, সোনাদিয়া দ্বীপ, ধলঘাটার হাঁসেরচর-সহ কালারমারছড়া ও হোয়ানকের পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের তীরঘেঁষে গড়ে ওঠা প্যারাবনগুলো কেটে ঘের নির্মাণ করা হয়েছে এবং নতুন নতুন প্যারাবন কেটে ঘের নির্মাণের কাজ করা হচ্ছে। আর এসব ঘেরের মালিকরা ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচিত।

বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত দুই মাসে বঙ্গোপসাগরের তীরঘেঁষে অমাবস্যাখালী মৌজার বগাচতর ঘোনা ও শাহাব উদ্দীনের ঘোনায় প্যারাবন কেটে দুটি বিশাল আকৃতির ঘের নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে বনবিভাগের লোকজন অভিযান চালিয়ে মাটি কাটার এক্সকাভেটর ও ঘেরের বাঁধ কেটে দেয়। ওই সময় জড়িতদের বিরুদ্ধে গোরকঘাটা রেঞ্জ অফিসের অধীনস্থ ঝাপুয়া বিটের বিট কর্মকর্তা মো. মাহবুবুল হক বাদী হয়ে দুটি মামলা দায়ের করেন। ওই দুটি মামলায় প্যারাবন কেটে ঘের নির্মাণ করে মোট ৫৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে গাছ কর্তন করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৮৩০টি, যার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১১ লাখ ৫১ হাজার টাকা, মাটি কাটা হয়েছে এক লাখ সাত হাজার ২০০ ঘনফুট, যার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা এবং বন ও পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে ২৭ লাখ টাকার।

হোয়ানক ইউনিয়নের কালাগাজির পাড়া গ্রামের পশ্চিমে বেড়িবাঁধের বাইরে অমাবস্যাখালী মৌজার বগাচতর নামক স্থানে প্যারাবন কাটার দায়ে ১২ জানুয়ারি তিনজনের বিরুদ্ধে প্রথম মামলাটি দায়ের করে বন বিভাগ। আসামিরা হলেনÑকুতুবদিয়া উপজেলার আলী আকবর ডেইল গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে মো. এরশাদ (৪৫), হোয়ানক ইউনিয়নের কালাগাজির পাড়া গ্রামের মৃত আবদুল খালেকের ছেলে মো. আবদুল মতিন (৪০) ও একই গ্রামের ফজুলল করিমের ছেলে নাজেম উদ্দীন নাজু (৪৫)। অপরদিকে একই মৌজার শাহাব উদ্দীনের ঘোনা নামক স্থানে প্যারাবন কাটায় ২১ জানুয়ারি চারজনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মামলাটি করে বন বিভাগ। মামলার আসামিরা হলেনÑহোয়ানক ইউনিয়নের মোহরাকাটা গ্রামের মৃত মৌ. মহিবুল্লাহর ছেলে মো. সাহাব উদ্দীন (৪৫), একই গ্রামের মৃত আবদুল গণির ছেলে মো. ইসহাক (৫০), বড়মহেশখালী ইউনিয়নের মুন্সির ডেইল গ্রামের মৃত ইউসুফ আলীর ছেলে মারুফুল হক (৫০) এবং মোহরাকাটা গ্রামের মৃত রশিদ আহমদের ছেলে ছদর আমিন (৫৫)।

মূলত প্যারাবন কেটে ঘের নির্মাণের এসব পরিবেশবিরোধী কাজে মামলার আসামিদের পেছনে রয়েছে জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক নেতাদের হাত। এ কারণে কোনোভাবেই থামছে না প্যারাবন ধ্বংসচক্রের পরিবেশবিধ্বংসী কাজগুলো। বনবিভাগের অভিযানের পরপরই রাতের অন্ধকারে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দলবেঁধে প্যারাবন কেটে ঘের নির্মাণের কাজ এখনও চালু রেখেছে তারা।

মহেশখালী বনবিভাগের উপকূলীয় রেঞ্জ কর্মকর্তা এসএম আনিসুর রহমান বলেন, ‘অভিযানের পরে মামলা দিয়েছি। কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে আমরা চলে আসার পরপরই আসামিরা প্যারাবন কেটে ঘের নির্মাণের কাজে আবারও নেমে পড়ে। মূলত জনবলের অভাবে ঠিকঠাকমতো অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না।’

বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুর রহমান বলেন, ‘মামলার পর প্যারাবন কেটে ঘের নির্মাণের দুটি স্থানই পরিদর্শন করেছি। এই প্যারাবন রক্ষায় স্থানীয়দের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি আমাদের সহযোগিতা করা দরকার। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি প্যারাবন রক্ষার জন্য।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘প্যারাবন কাটার বিষয়ে বনবিভাগের কোনো কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

পরিবেশ-বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপলের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, ‘দিনে-রাতে প্রকাশ্যে প্যারাবনের লাখ লাখ গাছ নিধন উদ্বেগের। আরও বেশি উদ্বেগের বিষয় হলো উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো ভূমিকা না থাকা। বন বিভাগ একার পক্ষে এসব বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে যৌথ অভিযান চালিয়ে দ্রুত প্যারাবন নিধন বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় পুরো উপকূল ঝুঁকির সম্মুখীন হবে।