প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

মাগুরায় ফুলশোলা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছে ৬০ পরিবার

 

 

মো. ইমাম জাফর, মাগুরা: মাগুরার  শালিখা উপজেলার শতপাড়া, সান্দরা, শ্রীপুর উপজেলার বরালদাহ, সদর উপজেলার দরিমাগুরা, বাটাজোড়সহ ১০ গ্রামে ফুল শোলার বিভিন্ন দৃষ্টি নন্দনসামগ্রী তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন অন্তত ৬০ পরিবার। যাদের মধ্যে শতপাড়ার শংকর মালাকার ফুল শোলা শিল্পে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। ভূষিত হয়েছেন বিসিকসহ বেশ কিছু সম্মাননা পদকে। এ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত কারুশিল্পীরা এটিকে পেশা হিসেবে আঁকড়ে ধরে পার করেছেন চার পুরুষ। প্রতিটি পরিবারে এসেছে সচ্ছলতা। প্রতি মাসে পরিবারপ্রতি আয় হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। সারা বছরই এসব পরিবারে চলে কর্মব্যস্ততা।

শালিখার শতপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শংকর মালাকারসহ ৬টি পরিবারের পুরুষ, নারী ও ছেলেমেয়েরা নিজেদের পুরোপুরি সম্পৃক্ত করেছেন শোলা শিল্পের সঙ্গে। শংকর মালাকারসহ আরও অনেকের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, তাদের পূর্বপুরুষদের কাছেই শিখেছেন শোলাশিল্পের এ কারুকাজ। তার পূর্বপুরুষ ফুল শোলাকেই জীবিকার উপকরণ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এমনকি তার পর্বের তিন পুরুষের পেশা ছিল এ শিল্প।

শংকর মালাকারের কাছ থেকে এ কাজ শিখেছেন তার স্ত্রী নিশা রাণী মালাকার, চাচাতো ভাই অমল মালাকার ও তার স্ত্রী ঝর্ণা রাণী মালাকার, পুত্র নিখিল মালকার ও তার স্ত্রী মিতালী রাণী মালাকার, নিমাই মালাকার ও  তার স্ত্রী কল্পনা রাণী মালাকার, পুত্র রামপ্রসাদ মালাকার ও স্ত্রী দিপালী রাণী মালাকার, জামাতা রতন মালকার ও তার পরিবারের অন্য দুজন নারীসদস্য। বংশানুক্রমে এ কাজ শিখে পড়াশোনার পাশাপাশি মা-বাবাকে সাহায্য করছে রত্না মালাকার ও লক্ষ্মী মালাকারসহ আরও অনেক স্কুল ও কলেজপড়–য়া শিক্ষার্থীরা।

শোলাশিল্পীরা আরও জানান,  বৈশাখ মাসের শেষের দিকের বর্ষণে ফুল শোলার বীজ বপন করা হয় অথবা এমনিতেই চারা গজাতে থাকে ডোবা জমি কিংবা ধানি জমিতে। মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার বেনিপুরের মাঠ, শালিখা উপজেলার আড়পাড়ার কালার বিল, শালিখার বগনাল বিল ও হিজলিবিল এবং সদর উপজেলার পলিতা গ্রামের কাতলামারি বিল ও কাব্লাশের বিলে প্রচুর পরিমাণে ফুল শোলা জš§ায়। কোনো কোনো চাষি তাদের ধানের ক্ষেতে ফুল শোলার চাষ করে থাকেন। প্রতি বোঝা শোলা ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। প্রতি বোঝায় ২০০ থেকে ২৫০টি শোলা থাকে। ভাদ্র্র-কার্তিক মাস পর্যন্ত ফুল শোলার মৌসুম। বিল থেকে শোলাগুলো উঠিয়ে এনে প্রথমে শোকানো হয়। তারপর মালাকার সম্প্রদায়ে প্রচলিত যন্ত্র কাইত (ছুরি) দ্বারা শুকনো শোলাগুলো ছেদন করতে হয়। ছেদ করা শোলাটুকরোগুলো কাইত (ছুরি) দ্বারা উপরস্থ বাকল পরিষ্কার করা হয়। কাইতই ফুল শোলা কর্তনের প্রধান অস্ত্র। কাজের ধরন অনুযায়ী বড়-মাঝারি-ছোট তিন আকৃতির কাইত রয়েছে। কাইত দ্বারা ফুল শোলাকে আড়াআড়ি করে কাগজের মতো করে ছেদন করতে হয় যাকে মালাকার সম্প্রদায় কাপ বলে থাকে। এ কাপ থেকে বিভিন্ন ডিজাইনের উপকরণ তৈরি করা হয়। কদমফুল তৈরি করার ক্ষেত্রে ফুল শোলার ছেদন করা টুকরাগুলোকে কদমফুলের শলাকার মতো করে চেরা হয়। কাপ দ্বারা বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করতে তুলোর সুতা পাটের সুতা ব্যবহার করা হয়। এরপর প্রয়োজন অনুযায়ী রঙ করা হয়। শোলার কারুকাজের উপকরণ তৈরি করতে অন্যান্য যন্ত্র বা বিষায়াদির মধ্যে রয়েছে কাঁইচি, বালিধারা, পিঁড়ি, রঙ, ময়দা, তুঁতে প্রভৃতি। ফুল শোলা দ্বারা তৈরি করা উপাদানের মধ্যে রয়েছে বিয়ের ফুল,  পূজার ফুল, বিয়ের টোপর, হাতপাখা, বেলিফুলের কুঁড়ি, বেলিমালা, কালি প্রতিমার মালা, কদমফুল, গোলাপফুল, গোলাপের তোড়া, হ্যাট, মুখোশ, বানর, কবুতর, কাকাতুয়া ও বিভিন্ন রকম খেলনা।

ফুল শোলার তৈরি উপকরণ মাগুরার বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত লক্ষ্মীপূজা, কালিপূজা, মনসাপূজায় চাহিদামাফিক ফুল সরবরাহ করেন শংকর মালাকারের পরিবার। এছাড়াও তিনি ঢাকায় নিউমার্কেট, শেওড়াপাড়া, জুরাইনে এসব উপকরণ সরবরাহ করেন। অংশ নেন বাংলা একাডেমির বৈশাখীমেলা, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও ফাউন্ডেশনের মাসব্যাপী মেলা, বিসিক মেলাসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মেলায়। এসব মেলায় অংশ নিয়ে শংকর মালাকার ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমির বিসিক মেলায় পেয়েছেন কারুগৌরবের পদক।