রেন্টাল-কুইক রেন্টাল থেকে ক্রমেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ। বর্তমানে উৎপাদনে রয়েছে দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে উৎপাদনে আসছে আরও তিনটি কেন্দ্র। সম্প্রতি এক বৈঠকে এ পাঁচটি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়, যা শেয়ার বিজের হাতে এসে পড়েছে। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের আজ ছাপা হচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব
ইসমাইল আলী: ২০২৪ সালের মধ্যে দেশে উৎপাদনে আসবে বেশকিছু কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর মধ্যে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরু করেছে ২০২০ সালে। আর গত মাসে জাতীয় গ্রিডে একটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে রামপাল কেন্দ্রটি। কয়েক মাসের মধ্যে আরও তিনটি কেন্দ্র উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে। তবে এসব কেন্দ্রের জন্য গুনতে হবে উচ্চ হারে ক্যাপাসিটি চার্জ। এমনকি কয়লা সংকটে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও এ চার্জ বন্ধ হবে না।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগে আদানির প্রতিনিধির সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ করে পাঁচ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয়ের হিসাব দেখানো হয়।
বৈঠকের তথ্যমতে, কয়লাভিত্তিক এ পাঁচটি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা পাঁচ হাজার ৫০৫ মেগাওয়াট। এগুলোর জন্য মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে প্রায় ১৪ কোটি ৯৬ লাখ ডলার বা এক হাজার ৫৯৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা (এক ডলার=১০৬.৯৫ টাকা ধরে)। এ হিসাবে বছরে এসব কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বছরে গুনতে হবে ১৭৯ কোটি ৫২ লাখ ডলার বা ১৯ হাজার ১৯৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
যদিও গত অর্থবছর বেসরকারি খাতের ৯৫টি কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে ১৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এ হিসাব থেকেই বোঝা যাচ্ছে কয়লাভিত্তিক এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ কতটা উচ্চ।
প্রথম পর্ব পড়ুন :
সূত্রমতে, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট। আগামী মার্চ থেকে এ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসার কথা। পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন শুরুর পর এ কেন্দ্রটির জন্য মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গুনতে হবে প্রায় তিন কোটি ৯৫ লাখ ডলার বা ৪২১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এতে বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ৪৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা পাঁচ হাজার ৫৯ কোটি ৯২ লাখ টাকা।
দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে গত ১৭ ডিসেম্বর উৎপাদন শুরু করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি, যা মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট নামে পরিচিত। ওই দিন এর ইউনিট-১ থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ যোগ হয়। চলতি বছর জুনে ইউনিট-২ থেকে জাতীয় গ্রিড বিদ্যুৎ যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। যদিও কয়লা সংকটে গত ১৪ জানুয়ারি এর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
প্রয়োজনীয় ডলার না পাওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কয়লা আমদানি বন্ধ রয়েছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ২৩৪ মেগাওয়াট। পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন শুরুর পর এ কেন্দ্রটির জন্য মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গুনতে হবে প্রায় তিন কোটি ৭১ লাখ ডলার বা ৩৯৭ কোটি আট লাখ টাকা। এতে বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ৪৪ কোটি ৫২ লাখ ডলার বা চার হাজার ৭৬৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)। বাংলাদেশের পিডিবি ও ভারতের জাতীয় তাপবিদ্যুৎ করপোরেশন (এনটিপিসি) কোম্পানিটির ৫০ শতাংশ করে শেয়ারের মালিক। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ঠিকাদার কোম্পানি ভারত হেভি ইলেক্ট্র্যিালস লিমিটেড (ভেল)। আর এটি নির্মাণে ঋণ দিয়েছে ভারতের এক্সিম ব্যাংক।
ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে এর পরের অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট। গত সপ্তাহে এটিতে পরীক্ষামূলক উৎপাদন করা হয়। আগামী এপ্রিলে মূল উৎপাদন শুরুর কথা রয়েছে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মিত এস আলম গ্রুপ ও চীনের সেপকো থ্রির যৌথ মালিকানাধীন এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টে উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ২২৪ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন শুরুর পর মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গুনতে হবে প্রায় তিন কোটি ৩৫ লাখ ডলার বা ৩৫৮ কোটি ২২ লাখ টাকা। এতে বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ৪০ কোটি ২০ লাখ ডলার বা চার হাজার ২৯৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে চতুর্থ অবস্থানে থাকা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট। ২০২০ সালে উৎপাদন শুরু করা এ কেন্দ্রটিতে মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গুনতে হয় প্রায় তিন কোটি ২৫ লাখ ডলার বা ৩৪৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এতে বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ৩৯ কোটি ডলার বা চার হাজার ১৭০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির যৌথ মালিকানায় রয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চীনের ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন লিমিটেড (সিএমসি)। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে দুই কোম্পানি সমান ১০ শতাংশ হারে মোট ২০ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। বাকিটা চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে।
এদিকে কয়েক মাসের মধ্যে উৎপাদন শুরুর কথা রয়েছে বরিশাল কয়লা বিদ্যুকৎকেন্দ্রটির। ৩০৭ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ কেন্দ্রটির জন্য মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গুনতে হয় প্রায় ৭০ লাখ ডলার বা ৭৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এতে বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় আট কোটি ৪০ ডলার বা ৯০১ কোটি ৯২ লাখ টাকা।
বরিশাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ২০১৮ সালের এপ্রিলে চুক্তি সই হয়। প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে চীনের ‘পাওয়ার চায়না রিসোর্স লিমিটেড’ ও বাংলাদেশের আইসোটেক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘আইসোটেক ইলেকট্রিফিকেশন কোম্পানি লিমিটেড’।
তৃতীয় পর্ব পড়ুন :
পিডিবির হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, মেগাওয়াটপ্রতি গড় ক্যাপাসিটি চার্জ সবচেয়ে বেশি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের। এ কেন্দ্রটির প্রতি মেগাওয়াটের জন্য মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ৩২ লাখ ১৮ হাজার টাকা। এরপর রয়েছে বাশখালী কেন্দ্রটি, যার মাসিক গড় ক্যাপাসিটি চার্জ ২৯ লাখ ২৭ হাজার টাকা। এছাড়া আদানির মেগাওয়াটপ্রতি গড় ক্যাপাসিটি চার্জ মাসে ২৮ লাখ ১৪ হাজার টাকা, পায়রার ২৭ লাখ ৯৪ হাজার টাকা ও বরিশাল কেন্দ্রটির ২৪ লাখ ৪৮ হাজার টাকা।
এদিকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জই শুধু বেশি নয়, এ কেন্দ্রটিতে কর্মরত ভারতের কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাও বেশি। এ কেন্দ্রে ৫৫ ভারতীয় নাগরিক কর্মরত রয়েছেন, যারা এনটিপিসির স্কেলে বেতন-ভাতা পান, যা পিডিবির কর্মকর্তাদের বেতনের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। এছাড়া তাদের মাসে দৈনিক ভাতা হিসেবে সাড়ে তিন হাজার ডলার দেয়া হয়, যা পিডিবির কর্মকর্তারা পান না। এতে ভারতের কর্মকর্তারা পিডিবির কর্মকর্তাদের চেয়ে প্রায় চারগুণ বেতন-ভাতা পান।