প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

মুজিব তোমার আরেক নাম স্বাধীন বাংলাদেশ

কাজী সালমা সুলতানা : শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলার মানুষের অহংকারের নাম, বিশ্বাসের নাম।  বাংলাদেশের স্থপতি তিনি। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত এই নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ তাঁর ১০৩তম জন্মদিন।

কিশোর বয়সেই মুজিব সমাজের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে এক সাহসী প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। অন্যায়ের কাছে কখনও মাথা নত করা এক সাহসী ধ্বনী। সম্পদ প্রভাব প্রতিপত্তি স্বার্থপরতা কখনও তাকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারে নাই। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার জীবন শুধুই অনুসরণীয়, অনুকরণীয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সৃষ্টি এবং বিজয়ের মুখোমুখি অগ্রসর হওয়ার নেতৃত্ব তিনিই দেন। বাঙালির মুক্তি আন্দোলন সংগ্রামের দীর্ঘ পথযাত্রায় বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের অবদান ছিল অতুলনীয়।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’ কবিতাটি শেখ মুজিবের জীবনবোধকেই যেন মনে করিয়ে দেয়। কবি বলেছেন, ‘আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা-কলুষিত-পুরাতন-পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। বিদ্রোহী কবির কবিতার বাণীর সঙ্গে বাঙালি জাতির মহানায়ক শেখ মুজিবের জীবনের ছন্দ যেন একই সুরে গাথা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ এবং জনগণের প্রতি মমত্ববোধের কারণে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। আদর্শবাদী ও আত্মত্যাগী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আজীবন সংগ্রাম করে গিয়েছেন, বাঙালি জাতিকে দিয়েছেন স্বাধীনতা। স্বাধীন বাংলাদেশ ও শেখ মুজিব যেন একই ছন্দে গাথা। সেই ছন্দটা ছিল আন্দোলন প্রতিবাদ প্রতিরোধ আর ত্যাগের।  

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের এই দিনে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জš§গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা শেখ লুৎফুর রহমান এবং মা সায়রা বেগম। মা-বাবা আদর করে তাকে খোকা বলে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধু তার মা-বাবাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। কারাগারের রোজনামচায় তিনি লিখেছেন, “আমার ওপর আমার মা-বাবার টান যে কত বেশি সে কথা কাহাকেও বোঝাতে পারব না। তারা আমাকে ‘খোকা’ বলে ডাকেন। মনে হয় আজও আমি তাদের ছোট্ট খোকাটি। পারলে কোলে করেই শুয়ে থাকে। এই বয়সেও আমি আমার মা-বাবার গলা ধরে আদর করি।” খোকার শৈশবকাল কাটে টুঙ্গিপাড়ায়।

কিশোর মুজিব বেরিবেরি ও পরে গ্লুকোমা থেকে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য দুই বছর পড়াশোনা বন্ধ থাকে। সে সময় মাদারীপুরে অবস্থানকালে দেখেন স্বদেশি আন্দোলনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। তিনিও যোগ দেন স্বদেশি আন্দোলনে। তখন থেকেই তার মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও রাজনৈতিক প্রতিভার বিকাশ প্রকাশিত হয়।

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম।”

১৯৩৭ সালে সুস্থ হয়ে তিনি গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। স্কুলের শিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ মুসলিম সেবা সমিতি গঠন করেছিলেন। তিনি মারা গেলে ওই সমিতির দায়িত্ব নেন শেখ মুজিব, হন সাধারণ সম্পাদক। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার মধ্য দিয়ে কিশোর শেখ মুজিব  প্রথম সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়।

পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি মুজিব নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন। বাসায় আসা আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ ও মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত পত্রিকা তিনি নিয়মিত পড়তেন। ‘একগুঁয়ে’ মুজিবের ছিল একটি দস্যি দল। সেই দলের ছেলেদের কেউ কিছু বললে তারা একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তেন (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)।

১৯৩৮ সাল ছিল শেখ মুজিবের জীবনের বাঁকবদলের বছর। গোপালগঞ্জে আসেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, সঙ্গে আসেন শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাদের আগমন উপলক্ষে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দায়িত্ব পড়ে শেখ মুজিবের কাঁধে। ওই বছরই গোপালগঞ্জে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লাগে। সে দাঙ্গায় আসামি হয়ে সাত দিনের জন্য তিনি জেল খাটেন। মুজিবের জেল জীবনের  শুরু সেই প্রথম।   

১৯৩৯ সালে তিনি কলকাতা গিয়ে শহীদ সাহেবের (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী) সঙ্গে দেখা করে গোপালগঞ্জ মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনের কথা বলেন। ১৯৩৯ সালে গোপালগঞ্জ মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।

১৯৪০ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন মুজিব। ছাত্ররাজনীতি করার মাঝেই ১৯৪১ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশ নেন। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ভর্তি হন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে। সে সময় তিনি থাকতেন বেকার হোস্টেলে। সে সময় ইসলামিয়া কলেজ ছিল বাংলাদেশের ছাত্র-আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। শেখ মুজিব এখানে থাকাবস্থায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এ সময় ছাত্রলীগের মধ্যে তার একক আধিপত্য গড়ে ওঠে। কিছুদিনের জন্য তিনি ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ১৯৪৮ সালে আইন পরিষদে ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে’ বলে ঘোষণা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে শেখ মুজিব এর প্রতিবাদ জানান। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তিনি বিক্ষোভে থাকা অবস্থায় ১১ মার্চ ১৯৪৮ পাকিস্তানি সেনা শাসক কর্তৃক গ্রেপ্তার হন। এরপর থেকে বহুবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য গ্রেপ্তার ও কারাভোগ করেন।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে শেখ মুজিব দলের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের আগমন উপলক্ষে আওয়ামী মুসলিম লীগ ভুখা মিছিল বের করে। এই মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ১৪ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমান আবারও গ্রেপ্তার ও কারাভোগে করেন।

বাংলা পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবুও আমরা বাংলা ও উর্দু দুইটা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলাম। পাঞ্জাবের লোকেরা পাঞ্জাবি ভাষা বলে, সিন্ধুর লোকেরা সিন্ধি ভাষায় কথা বলে, সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা পশতু ভাষায় কথা বলে, বেলুচরা বেলুচি ভাষায় কথা বলে। উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের ভাষা নয়, তবুও যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভায়েরা উর্দু ভাষার জন্য দাবি করে, আমরা আপত্তি করব কেন? যারা উর্দু ভাষা সমর্থন করে তাদের একমাত্র যুক্তি হলো উর্দু ‘ইসলামিক ভাষা’। উর্দু কি করে যে ইসলামিক ভাষা হলো আমরা বুঝতে পারলাম না।

দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকেরা আরবি বলে। পারস্যের লোকেরা ফার্সি বলে, তুরস্কের লোকেরা তুর্কি ভাষা বলে, ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলে, মালয়েশিয়ার লোকেরা মালয় ভাষায় কথা বলে, চীনের মুসলমানরা চীনা ভাষায় কথা বলে। এ সম্বন্ধে অনেক যুক্তিপুর্ণ কথা বলা চলে। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেয়া যাবে ভেবেছিল, কিন্তু পারে নাই। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)

 ১৯৫২ সালে রাজবন্দি মুক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি জনগণের নেতা মুজিব জেলখানায় একটানা ১৭ দিন অনশন অব্যাহত রাখেন।

১৯৫৩ সালে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালের ৫ জুন তিনি গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ প্রত্যাহার করা হয়।

১৯৫৬, ১৯৫৭, ১৯৫৮ ও ১৯৬১ সালের ধারাবাহিক আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব ক্রমেই বাংলার জনগণের প্রিয় নেতার আসন লাভ করেন। ১৯৬২ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য বিশিষ্ট ছাত্রনেতাদের দ্বারা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। তারা দেশ এই নিউক্লিয়াস ৬২ থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর আস্থাশীল ছাত্রলীগের মাধ্যমে।

  শেখ মুজিব ১৯৬২ সালে শরিফ কমিশন নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন ও ১৯৬৬ সালে লাহোরে বাঙালির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন। বঙ্গবন্ধু ছয় দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সারাদেশে ৩২টি সভায় গণসংযাগ করেন। এ সময়  তিনি সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় চারবার গ্রেপ্তার হন। বঙ্গবন্ধু এ সময় বছরের প্রথম তিন মাসে আটবার গ্রেপ্তার হন। ক্রমেই তিনি হয়ে হয়ে ওঠেন বাঙালির নেতা। পাকিস্তানে ২৩ বছর শাসনামলে বঙ্গবন্ধু ১৮ বার  কারাবরণ করেন এবং সাড়ে ১১ বছর কারাভোগ করেন।

 ১৯৬৯ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সেই সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

১৯৭০ সালের ৫ ডিসেম্বর জনগণের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা দেন আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তানে’র পরিবর্তে শুধু ‘বাংলাদেশ’। অবশেষে ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তার সেই ডাকে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা বাংলা। তারই ডাকে বাংলার কৃষক শ্রমিক ছাত্র ছাত্রী, তরুণ-তরুণী  দেশের সকল শ্রেণির মানুষ জনযুদ্ধে ঝাঁপিড়ে পড়ে। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদ ও ৫ লাখ নারী শিশুর জীবন ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভ করে বাঙালি। বাংলার আকাশে উড়তে থাকে মুক্তির পতাকা। স্বাধীনতার পতাকা যার তার সঙ্গে মিশে আছেন বাঙালির প্রেরণা ভালোবাসা চির শ্রদ্ধার শেখ মুজিবুর রহমান।

গণমাধ্যমকর্মী

[email protected]