মীর কামরুজ্জামান, যশোর: সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়ে বাজারে ধানের দাম বেশি থাকায় যশোরে খাদ্য বিভাগের চলতি আমন সংগ্রহ অভিযানের সফলতা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। গত ১৭ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া জেলার আমন সংগ্রহ অভিযানের দীর্ঘ ৭০ দিন পার হলেও এখনও এক কেজি ধানও সংগ্রহ করতে পারেনি খাদ্য বিভাগ। জেলার আট উপজেলায় আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি শেষ হবে আমন মৌসুমের ধান সংগ্রহ অভিযান।
খাদ্য বিভাগের মাঠ কর্মকর্তাদের মতে, বাজারদরের তুলনায় সরকারি দাম কম থাকায় কৃষকরা খাদ্যগুদামে ধান বিক্রিতে আগ্রহী না হওয়ার কারণই ধান সংগ্রহে ব্যর্থতার মূল বিষয়। এমন পরিস্থিতিতে যশোর জেলায় আমন সংগ্রহ সফল না হওয়ার আশঙ্কা জোরালো হয়ে উঠেছে। তবে ধান সংগ্রহ করতে না পারলেও সিদ্ধ চাল সংগ্রহে যশোর অনেকটা এগিয়ে আছে বলে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে।
যশোর জেলা খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে যশোর জেলার আমন সংগ্রহ অভিযানে ১৪ হাজার ৯৯৭ মেট্রিক টন ধান এবং চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে জেলায় কৃষকদের কাছ থেকে ২৮ টাকা কেজি দরে চার হাজার ৯৯৮ মেট্রিক টন ধান এবং মিল মালিকদের কাছ থেকে ৪২ টাকা কেজি দরে ৯ হাজার ৯৯৯ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে গত বছরের ১৭ নভেম্বর আমন সংগ্রহ অভিযান শুরু করে খাদ্য বিভাগ। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ সংগ্রহ অভিযান চলবে।
যশোর জেলা খাদ্য অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংগ্রহ অভিযানের আড়াই মাস পেরিয়ে গেলেও গত বুধবার পর্যন্ত জেলার আট উপজেলার কোনো খাদ্যগুদামে এক কেজি ধানও সংগ্রহ হয়নি। তবে এ সময়ে চাল সংগ্রহ হয়েছে পাঁচ হাজার ২৭২ টন ৪৯০ কেজি, যা মোট সংগ্রহের ৬৫ শতাংশ বলে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অধিদপ্তর দাবি করছে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে ধান সংগ্রহের ব্যাপারে পুরোপুরিই আশা ছেড়ে দিয়েছে দপ্তরটি। কারণ সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়ে বাজারে ধানের দাম বেশি হওয়ায় সংগ্রহ অভিযান শুরুর দিকে কৃষকরা তাদের ধান বিক্রি করে ফেলেছে, যে কারণে এই মূহূর্তে কোনো কৃষকের ঘরে ধান নেই। কৃষক এই মূহূর্তে বোরোর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। এসব কারণে ধান ক্রয় করার কোনো সুযোগ নেই খাদ্য অধিদপ্তরের। এজন্য তারা চুক্তিবদ্ধ চালকল মালিকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহের জন্য চেষ্টা করছেন।
যশোর জেলা খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি আমন মৌসুমে আট উপজেলায় ১৯৭টি চালকলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলেও এখন পর্যন্ত অনেক চালকল থেকে খাদ্যগুদামগুলোয় চাল সরবরাহ করা হয়নি। সরকার-নির্ধারিত প্রতিকেজি চাল ৪২ টাকা নির্ধারণ করা হলেও বাজারে এই মুহূর্তে মোটা চাল ৪৫ থেকে ৪৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এ অবস্থায় মিলাররা চাল দেয়া নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। খাদ্য বিভাগ থেকে প্রতিনিয়ত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে চাল দেয়ার জন্য।
এ বিষয়ে যশোর খাদ্য অফিসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ কয়েকজন মিলার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাজারে ধান ও চালের দামের সঙ্গে সরকার-নির্ধারিত দামের বিস্তর পার্থক্য হওয়ায় আমরা বড় ধরনের সংকটে আছি। একদিকে বিদ্যুতের দাম বেশি, অন্যদিকে শ্রম খরচ বেড়েছে। সেইসঙ্গে বাড়তি দামে ধান কিনে চাল বানিয়ে প্রতিকেজির দাম সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়ে দু-তিন টাকা বেশি পড়ছে। এতে পুঁজি বাঁচছে না। মিলাররা জানান, তারা খাদ্য বিভাগের কাছে বারবার দাবি করে আসছেন সরকার-নির্ধারিত সংগ্রহ মূল্য একটু বাড়িয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু সে বিষয়ে কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে আমাদের চাল দিতে চাপ দেয়া হচ্ছে। অন্যথায় লাইসেন্স বাতিল করা হবে বলে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিত্যানন্দ কুণ্ডু বলেন, বাজারে ধানের দাম আর সরকারের সংগ্রহের দামের মধ্যে পার্থক্য থাকায় আমরা আপাতত ধান সংগ্রহের বিষয়ে আশাবাদী হচ্ছি না। তবে আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, চাল নিয়ে মিলারদের সঙ্গে যে চুক্তি রয়েছে, সে চুক্তি অনুযায়ী আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চাল সংগ্রহ করতে পারব। তিনি বলেন, এ মুহূর্তে জেলায় পাঁচ হাজার ২৭২ টন চাল সংগ্রহ হয়েছে, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৬৫ শতাংশ। বাকি এক মাসের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী শতভাগ চাল সংগ্রহ করতে পারব বলে আশা করছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মিলাররা লাভ করতে পারছেন না বলে যে দাবি করেছেন, তা সঠিক নয়। তারা বাজারে চাল বিক্রি করেন বাকিতে। অথচ আমাদের কাছে সকালে চাল দিলে বিকালে টাকা পেয়ে যাচ্ছেন। এর চেয়ে বড় সুবিধা আর হতে পারে না। তাছাড়া তারা যেহেতু আমাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ, সে কারণে নির্ধারিত সময়ে খাদ্যগুদামে তারা চাল সংগ্রহ করবে বলে আশা করছি। আর এর ব্যত্যয় ঘটলে যারা চাল দিতে পারবে না, তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে।