প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

যোগাযোগে নতুন দিনের সূচনা কম সময়ে যাতায়াতের সুযোগ

রেজাউল করিম খোকন: আমাদের জন্য একটি আনন্দময় দিন ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর। এই দিনে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে আধুনিক গণপরিবহন মেট্রো যুগে, যা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট বা সংক্ষেপে এমআরটি নামে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পরদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার থেকে ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এ পথে যাত্রী নিয়ে চলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক ট্রেন। পরবর্তী ধাপে এটি আগারগাঁও থেকে কমলাপুর পর্যন্ত চলাচল করবে। ২০১৬ সালের ২৬ জুন এমআরটি লাইন-৬-এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, সাড়ে তিন মিনিট অন্তর ট্রেন চলবে। তবে শুরুর দিকে ১০ মিনিট অন্তর চলছে। উত্তরা উত্তর (দিয়াবাড়ী) এবং আগারগাঁও স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ১০ মিনিট করে অপেক্ষা করে যাত্রী ওঠানো-নামানোর সুবিধার্থে। আগামী মাস বা এপ্রিলে মেট্রোরেল পুরোপুরি বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যাওয়ার পর স্টেশনে মাত্র ৩০ সেকেন্ড যাত্রাবিরতি করবে। যাত্রীদের অভ্যস্ত হতে শুরুর দিকে বাড়তি সময় দেয়া হবে। উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁওয়ের ভাড়া ৬০ টাকা। সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা দুই হাজার ৩০৮ জন হলেও শুরুর দিকে প্রতিটি ট্রেন ১০০ থেকে ৩৫০ যাত্রী নিয়ে চলবে। মেট্রোরেলের ছয় বগির ট্রেনের দুই দিকেই থাকবে ট্রেইলার কোচ, যেখান থেকে চালকেরা ট্রেন পরিচালনা করবেন। প্রতিটি ট্রেইলার কোচের যাত্রী ধারণক্ষমতা ৩৭৪ জন। মেট্রোরেল চলবে বিদ্যুতে। জাতীয় সঞ্চালন লাইন গ্রিড থেকে সরাসরি বিদ্যুৎ-সংযোগ থাকছে মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর ও মতিঝিল সাবস্টেশনে। থাকবে বিকল্প সংযোগও। বিদ্যুৎবিভ্রাট হলে চলবে জেনারেটর। ট্রেনের প্রথম ও শেষের বগিতে থাকবে ট্রেন পরিচালনার মডিউল। ফলে ট্রেন না ঘুরিয়েই চালানো হবে। ট্রেন নিয়ন্ত্রণে চালকদের কাজ সামান্যই। ট্রেন চলবে সফটওয়্যারে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্যমতে, বছরে দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৫ শতাংশ ক্ষতি করছে যানজট, টাকার অঙ্কে ৮৭ হাজার কোটি টাকা। দিয়াবাড়ী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত নির্মাণাধীন এমআরটি-৬ লাইন যানজটের ক্ষতি কমাবে ৯ শতাংশ। বর্তমান সরকারের আমলে যে কটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, মেট্রোরেল তার অন্যতম। গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের যোগযোগ অনেক সহজ ও সাশ্রয়ী হয়েছে। মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকা শহরের যানজট ও মানুষের ভোগান্তি অনেকাংশে কমবে বলে আশা করা যায়। মেট্রোরেল কেবল দ্রুত পরিবহন নয়, এটি পরিবেশবান্ধবও। বাংলাদেশে মেট্রোরেল নতুন পরিবহন হওয়ায় এর সঙ্গে অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে। ফলে কর্তৃপক্ষকে যাত্রীদের সচেতন করার পাশাপাশি নিজেদেরও সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। জাতির অগ্রগতির প্রতীক এই পরিবহন কারও গাফিলতি বা ভুলে ক্ষতিগ্রস্ত হোক, সেটা কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না। মেট্রোরেল ঢাকার জনজীবনে গতি আনুক।

যানজটের নগর ঢাকার নাগরিকদের স্বস্তি দিতে মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয় ২০০৫ সালে। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মূল কাজ শুরু হয় ২০১৬। বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ বড় শহরগুলোয় মেট্রোরেল-ব্যবস্থা রয়েছে। এ ধরনের গণপরিবহন চালুর অন্যতম উদ্দেশ্য মানুষের যোগাযোগকে সহজ ও সময় সাশ্রয়ী করা। এতে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতিও বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়। এসব দিক বিবেচনায় রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল চালু হওয়া একটা বৈপ্লবিক ব্যাপার। মেট্রোরেল যানজট এড়িয়ে আমাদের গণমানুষের যাতায়াতের সময় বাঁচাবে। এর ফলে অনেক কর্মঘণ্টা আমরা পাব, যে কর্মঘণ্টাগুলো মানুষ কোনো না কোনো কাজে লাগাতে পারবে। এমনকি মানুষ যদি বিশ্রামও নেয়, তাতে তাদের অন্য কাজের গতিশীলতাও বাড়বে। অর্থাৎ মেট্রোরেলের মাধ্যমে শুধু যে তাৎক্ষণিক যাতায়াতের সময় বাঁচবে তা নয়, গণমানুষের কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতাও বাড়বে। মেট্রোরেলের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও অসুস্থ মানুষসহ সবাই উপকৃত হবেন। যেহেতু অর্থনীতিকে চালায় মানুষ, আর তাই এই মানুষ যত বেশি দক্ষ ও কর্মক্ষম হবে, তত বেশি অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবে। পাশাপাশি মেট্রোরেলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে। এসব দিক থেকে মেট্রোরেল অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। অর্থনৈতিক ভূমিকার পাশাপাশি মেট্রোরেল চালুর ফলে ঢাকায় দূষণের পরিমাণও কমাতে পারে। প্রধানমন্ত্রীও মেট্রোরেলকে পরিবেশবান্ধব বাহন বলেছেন। তবে মেট্রোরেল কোনোভাবেই বাস বা অন্যান্য গণপরিবহনের পুরোপুরি বিকল্প নয়। তাই মেট্রোরেলের পাশাপাশি উন্নত গণপরিবহনের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত গাড়ির পরিমাণ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

উত্তরা-আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের যাত্রা শুরু হয় গত ২৮ ডিসেম্বর। ওই দিন রাজধানীর রাজধানীর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পৌনে ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়া যাচ্ছে ১০ মিনিট ১০ সেকেন্ডে। যানজটের নগরী ঢাকার মানুষকে কয়েক মাস আগে বললেও এটা তারা বিশ্বাস করতে চাইতেন না। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। সড়কপথে এখন ঢাকা থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে বরিশালে যাওয়া যাচ্ছে। অথচ লঞ্চে বরিশাল যেতে সারারাত লাগে। ফেরিতে পার হলে কখনও কখনও ১০ ঘণ্টা বা এরও বেশি সময় সড়কে কাটাতে হয়। আর ফেরিঘাটের ভোগার্ন্তি, হকারের উৎপাত, ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে টানাহেঁচড়া তো আছেই। এখন কম সময়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাওয়া যাচ্ছে পদ্মা সেতু দিয়ে। বিশেষজ্ঞ থেকে সাধারণ মানুষ সবাই স্বীকার করছেন, পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে নতুন যুগে নিয়ে গেছে। বাস্তবায়নাধীন ১০টি বড় উন্নয়ন প্রকল্পকে অগ্রাধিকারের তালিকায় (ফাস্ট-ট্র্যাক) রেখেছে সরকার। এর মধ্যে যোগাযোগ খাতের প্রকল্পগুলো হচ্ছে পদ্মার দুই পারে রেলসংযোগ স্থাপন ও মেট্রোরেল। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল অগ্রাধিকারের তালিকায় না থাকলেও এটি বড় ও ব্যতিক্রমী প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত।

পদ্মা সেতু চালু হয়েছে গত ২৫ জুন। আর ২৮ ডিসেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মেট্রোরেল উত্তরা-আগারগাঁও পর্র্যন্ত চলছে। কর্ণফুলীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের আগামী ফেব্রুয়ারিতে (২০২৩) চালুর পরিকল্পনা আছে। আগামী জুনে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্র্যন্ত রেললাইন চালুর মাধ্যমে পদ্মা সেতুর দুই পার জুড়ে দেয়ার কথা জানিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে সরকার গত নভেম্বরে এক দিনে সারাদেশে ছোট-বড় ১০০ সেতু চালু করেছে। ডিসেম্বরে ১০০টি জাতীয় মহাসড়কে দুই হাজার কিলোমিটার নতুন সড়ক একই দিনে উদ্বোধন করা হয়।

এ থেকেই বোঝা যায়, ২০২২ সাল যোগাযোগ খাতে অনেক সুখবর দিয়েছে। এর রেশ হয়তো আগামী বছরও থাকবে। তবে এসব সেতু, সড়ক ও রেল যোগাযোগে স্বস্তি আনলেও মানুষের মনে কিছু প্রশ্ন-সন্দেহ থাকা অস্বাভাবিক নয়, কেননা একটি প্রকল্পও সময়মতো এবং নির্ধারিত ব্যয়ের মধ্যে শেষ করা হয়নি। এর ফলে মানুষ যে সময়ের মধ্যে এর সুফল ভোগ করতে পারত, তা থেকে অনেক পরে সেই ফল পাচ্ছে। সরকারের কোষাগার খালি করা এবং বিদেশি ঋণের বোঝা বাড়ানোর বিষয়টিও আলোচনার দাবি রাখে। ২০০৭ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্প গ্রহণের পর তা চালু হতে ১৫ বছর লেগেছে। ব্যয় বেড়েছে ২২ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। ২০১২ সালে নেয়া মেট্রোরেল প্রকল্প এক দশক পর আংশিক চালু হয়েছে। ব্যয় বেড়েছে ১১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। নগরবাসী দীর্ঘদিন নির্মাণকাজের জন্য ভোগার্ন্তির শিকার হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণকাজ নির্ধারিত সময়ে সম্ভব না হলেও বেশি দেরি হচ্ছে না। তবে প্রকল্পের ব্যয় দুই হাজার কোটি টাকা বাড়ছে।

পদ্মা সেতু শুধু যে যাত্রার সময় কমাচ্ছে, তা-ই নয়। গত ২৫ জুন চালু হওয়ার পর পদ্মা সেতু দিয়ে ২৭ লাখের বেশি যানবাহন পারাপার হয়েছে। টোল থেকে সরকারের আয় হয়েছে ৪০০ কোটি টাকার বেশি। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৫ হাজার যানবাহনের চলাচল থেকে বোঝা যায়, ওই অঞ্চলের অর্থনীতির চাকাও ঘুরছে। এর মধ্যে বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের তাজা মাছ কম সময়ে ঢাকার বাজারে চলে আসার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। স্থানীয় অনেক পণ্য এখন কম সময়ে ঢাকায় আসছে। শিল্পোদ্যোক্তারা কারখানা করার লক্ষ্যে জমি কিনছেন দেদার। ফলে জমির বাজার ব্যাপক গরম হয়েছে। অথচ এই পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়ার পর এর সুফল পেতে লেগেছে দুই যুগের মতো। ১৯৯৯ সালের মে মাসে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য প্রাক্-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা (প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি) শুরু হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার অর্থায়নে ২০০৩-০৫ সালের মধ্যে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার কাজ করে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। পদ্মা সেতু নির্মাণে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রকল্প নেয় ২০০৭ সালে। ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। চার বছরে নির্মাণ করার কথা। কিন্তু নানা জটিলতায় কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে। শেষ পর্র্যন্ত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা। পদ্মা সেতু দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯ জেলাকে ঢাকাসহ সারাদেশের সঙ্গে যুক্ত করেছে। সমীক্ষায় এসেছিল, সেতুটি চালুর পর দেশের জিডিপির হার বাড়াবে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়াবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে এই প্রভাব কতটা অর্জিত হলো, তা পরে মূল্যায়নে স্পষ্ট হবে।

পদ্মা সেতুর মতো মেট্রোরেল চালুর পরও একধরনের আবেগতাড়িত যাত্রা (ইমোশনাল রাইড) দেখা গেছে। ১০ মিনিটের যাত্রার টিকিট কাটার জন্য দুই ঘণ্টা পর্র্যন্ত মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেছে। মেট্রোরেলে উঠে ছবি তোলা, ভিডিও করা, পরে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশের ঘটনা কদিন জোরেশোরে চলে। দূরদূরান্ত থেকেও মানুষ মেট্রোরেল দেখতে, চড়তে আসেন। রাজধানীর লক্কড়ঝক্কড় ও জীর্ণ বাসের বিপরীতে জাপানে তৈরি মেট্রোরেলের কোচগুলো অত্যাধুনিক। তিনতলা মেট্রোরেল স্টেশনে ওঠানামার জন্য সিঁড়ি, চর্লন্ত সিঁড়ি (এস্কেলেটর) ও লিফট রয়েছে। ট্রেন ও স্টেশন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি)। আগামী বছর ডিসেম্বরে মতিঝিল পর্র্যন্ত মেট্রোরেল চালু করা হবে। কমলাপুর পর্র্যন্ত চালু হতে সময় লাগবে ২০২৫ সাল পর্র্যন্ত। পুরোটা চালু হলে ঘণ্টায় ৬০ হাজার এবং দৈনিক পাঁচ লাখ যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। এই পথ যেতে সময় লাগবে ৩৮ মিনিট। মেট্রোরেলের প্রথম পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল ২০০৫ সালে, কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি)। এরপর মাস গেছে, বছর গেছে, যুগ গেছে, মানুষের অপেক্ষা শুধু বেড়েছে। ২০১২ সালে প্রথম প্রকল্প নেয়া হয়। ২০১৬ সালে দেখা গেল, বেগম রোকেয়া সরণিতে সড়কের মাঝখানে কংক্রিটের ব্লকের বেড়া দিয়ে শুরু হয়েছে মেট্রোরেলের কাজ। ছয় বছর পর মেট্রোরেল চলাচল শুরু করল। চালু হওয়া মেট্রোরেল প্রকল্পটির নাম এমআরটি লাইন-৬। উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্র্যন্ত এর দৈর্ঘ্য ২১ কিলোমিটারের বেশি। এর মধ্যে ১৭টি স্টেশন থাকছে। গত ২৮ ডিসেম্বর চালু হয়েছে সাতটি স্টেশনের মধ্যে। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এখন ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরেকটি নতুন সংযোজন। টানেলে দুটি টিউব (সুড়ঙ্গ) রয়েছে। এর মধ্যে আনোয়ারা থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসার টিউবের পূর্ত কাজ শেষ হয়েছে। আর চট্টগ্রাম থেকে আনোয়ারার দিকে চলাচলের টিউবটির কাজ শেষ পর্যায়ে। নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল এটি। কর্ণফুলীর দুই তীরকে সংযুক্ত করে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে টানেল প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। দুই টিউবসংবলিত মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম শহরকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। এক ভাগে রয়েছে নগর ও বন্দর এবং অন্য ভাগে রয়েছে ভারী শিল্প এলাকা। কর্ণফুলী নদীর ওপর এরই মধ্যে তিনটি সেতু নির্মিত হয়েছে। তবে তা যানবাহনের চাপ সামলাতে যথেষ্ট নয়। এর বাইরে কক্সবাজার পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, একে ঘিরে পর্যটন বাড়ছে। এর মধ্যে মহেশখালীতে গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। মাতারবাড়ীতে চলছে গভীর সমুদ্রবন্দর ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ। সব মিলিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি হাব হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা আছে। চট্টগ্রামে বে-টার্মিনাল হবে। কর্ণফুলী নদীর এই দুই পারের কর্মযজ্ঞ বিবেচনায় নিয়ে নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের প্রকল্প নেয়া হয়, যা চট্টগ্রাম শহর ও আনোয়ারা উপজেলাকে যুক্ত করবে। ২০১৪ সালে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ও চীনের সরকারি পর্যায়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়। নকশা ও অন্যান্য কাজ শেষে ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি টানেলের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল আট হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোকে ‘স্মার্ট হাইওয়ে’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা আছে সরকারের। এজন্য সারাদেশের নদী-খাল-বিলের দুই পাড়ের সংযোগ ঘটানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি অনগ্রসর অঞ্চলগুলোকে যোগাযোগকাঠামোতে আনার চেষ্টা চলছে। এর অংশ হিসেবে গত ৭ নভেম্বর সারাদেশে এক দিনে ‘শত সেতু’ উদ্বোধন করা হয়। এসব সেতুর সবচেয়ে বড়টি সুনামগঞ্জের রানীগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর ওপর নির্মিত হয়েছে, যা ৭০২ মিটার দীর্ঘ। এই সেতুর ফলে ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জের দূরত্ব ৩৮ কিলোমিটার কমে গেছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বাকি সেতুগুলোর বেশির ভাগই ১৫০ মিটার বা এর কম দীর্ঘ। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের অধীনে নির্মিত এসব সেতু দেশের সাতটি বিভাগের ২৫টি জেলায় হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ৪৬টি ছোট-বড় সেতু নির্মিত হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। এর মধ্যে পার্বত্য জেলাগুলো সবচেয়ে বেশি-৪৪টি। সব কটি সেতু একসঙ্গে জোড়া দিলে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে। সওজ বলছে, এসব সেতুর নকশা প্রণয়ন করেছে নিজেরাই। নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ঠিক রাখার দিকটি বিবেচনায় রাখা হয়েছে। সেতুগুলো নির্মাণে প্রায় ৮৮০ কোটি টাকার পুরোটা সরকারের রাজস্ব খাত থেকে খরচ করা হয়েছে। এর বাইরে আরও ১১৮টি ছোট-বড় সেতু নির্মাণাধীন। এগুলোর মোট দৈর্ঘ্য ৯ কিলোমিটারের বেশি। এগুলো চলতি বছরের মধ্যে চালুর পরিকল্পনা আছে।

শত সেতুর পর সর্বশেষ গত ২১ ডিসেম্বর দেশের ১০০ সড়কের অংশবিশেষ নির্মাণ ও উন্নয়ন করা হয়েছে। এসব উন্নয়ন করা সড়কের মোট দৈর্ঘ্য দুই হাজার ২১ কিলোমিটার। এর বেশির ভাগই গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক। সওজের তথ্য অনুসারে, দেশের আটটি বিভাগের ৫০টি জেলায় বিস্মৃত এসব সড়ক। মোট ৪৮টি উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে প্রায় ১৪ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এসব সড়ক-মহাসড়ক উন্নয়ন করা হয়েছে। এই ব্যয়ের বেশির ভাগ অর্থের জোগান দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় মহাসড়কটি সাউথ এশিয়া সাবরিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) প্রকল্পের আওতায় নির্মিত হয়েছে, যা জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা মহাসড়ক নামে পরিচিত। দুই পাশে স্থানীয় যানবাহনের যাতায়াতের ব্যবস্থাসহ মহাসড়কটির প্রায় ৭০ কিলোমিটার চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। সবচেয়ে ছোট ইজতেমা সড়কের দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার। উন্নয়ন করা সড়কের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পড়েছে ঢাকা বিভাগে, প্রায় ৬৫৪ কিলোমিটার। জেলা হিসেবে সবচেয়ে বেশি সড়ক উন্নয়ন হয়েছে গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামে। আশির দশকে দেশের যোগাযোগ খাতে বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণের ধারা শুরু হয়েছিল। গত এক যুগে এই খাতে বিনিয়োগ আরও বেড়েছে। পদ্মা সেতু চালুর মাধ্যমে সরকার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেছে। নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের বিষয়টি দেশে-বিদেশে আলোচিত হয়েছে। মেট্রোরেলের একাংশ চালুর মাধ্যমেও ঢাকার মানুষের মধ্যে একধরনের সাড়া ফেলা গেছে। আগামী নির্বাচনের আগে মতিঝিল পর্র্যন্ত মেট্রোরেল চালুর সিদ্ধান্ত আছে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু টানেল চালু হয়ে যাবে। বিদায়ী ২০২২ সাল যোগাযোগ খাতে অনেক সুখবর দিয়েছে। এর রেশ হয়তো এ বছরও থাকবে।

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক