কাজী সালমা সুলতানা: ২৬ মার্চ, ১৯৭১। ২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর থেকেই ঢাকাসহ বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট থেকে সৈন্যরা সশস্ত্র হয়ে বের হতে থাকে। সেনাবাহিনী বিমানবন্দরে অবস্থান নেয়।
রাত ১২টা ৩০ মিনিট। ধ্বংসের তোপ গর্জে ওঠে। বাঙালি নিধন শুরু হয়। শুরু হয় গণহত্যা। আগুনের লেলিহান শিখায় বাংলাকে ছারখার করা শুরু হয়। ট্যাংক-মর্টারের গুলিসহ আগুনের লেলিহান শিখায় রাত ২টার মধ্যে ঢাকা এক ভুতুড়ে নগরী হয়ে যায়।
এই কালরাতে বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলোর শিক্ষকসহ শত শত ছাত্রছাত্রীকে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দি পিপল, সংবাদ, ইত্তেফাক ও বাংলার বাণী অফিস এবং কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার ট্যাংকের গোলায় ধ্বংস করে দেয়।
শহিদ কবি সাবের সংবাদ অফিসেই জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হন। এদিকে রাত ১১টা ৩৮ মিনিটে মুক্তি সংগ্রামের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতে পিলখানায় ইপিআর ঘাঁটি ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনস আক্রমণ করেছে এবং শহরের লোকজনদের হত্যা করছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিগুলোর কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশÑদেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। কোনো আপস নেই, জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সব দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপ্রিয় লোকদের কাছে এই সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’
জš§ নেয় বাঙালির জাতিরাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি, যে যেখানে আছ, যার যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।’
রাত ১টায় কর্নেল জেড এ খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটা দল ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে পৌঁছে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চালাতে শুরু করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক স্থানীয় পুলিশকর্মী সেই গুলিতে মারা যান। দোতলায় বঙ্গবন্ধু স্ত্রী ও সন্তানদের একটা ঘরে বন্ধ করে বাইরে থেকে আটকিয়ে দেন এবং যতটা সম্ভব জোরে চেঁচিয়ে বলে ওঠেন, ‘ফায়ারিং বন্ধ করো।’ বঙ্গবন্ধু ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কর্নেল জেড এ খান বঙ্গবন্ধুকে আদেশ করেন তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য। তিনি পরিবারের সবার সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে আসেন। এরপর ৫৭ ব্রিগেডের মেজর জাফর ওয়ারলেস মেসেজ পাঠানÑ‘বিগ বার্ড ইন কেজ, স্মল বার্ডস হ্যাভ ফ্লোন।’ ওই রাতে বঙ্গবন্ধুসহ সবাইকে আদমজি স্কুলে রাখা হয়। সকালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গ্রেপ্তার করা সবাইকে ছেড়ে দেয়া হয়। পরদিন বঙ্গবন্ধুকে ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়।
শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীন বাংলার অবরুদ্ধ রাজধানী ঢাকা ছাড়া সমগ্র বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনার দিনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয়।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে সশস্ত্র যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে দেশের সর্বত্র চলে সশস্ত্র প্রতিরোধ। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হ্যান্ডবিল আকারে ইংরেজি ও বাংলায় ছাপিয়ে চট্টগ্রামে বিলি করা হয়। আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে ইপিআর সদর দপ্তর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়ারলেস মারফত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান বেলা ২টা ১০ মিনিটে ও ২টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।
পাক হানাদার বাহিনী ঢাকায় দিনরাত কারফিউ দিয়ে দলে দলে রাস্তায় নেমে ভবন ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বাসভবনের ওপর ভারী মেশিনগান ও কামানের গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। বিদেশি সাংবাদিকদের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আটক রাখা হয়। অবাঙালি নাগরিকদের সহযোগিতায় পাক সেনারা দুপুরে পুরোনো ঢাকা আক্রমণ করে এবং মধ্যরাত পর্যন্ত ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
সকালে পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো কড়া সামরিক প্রহরায় ঢাকা ত্যাগ করেন।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও বিবিসি সংবাদ